‘মডার্ন’ হাসপাতালের এ কেমন আচরণ?
বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতালের সাবেক চিফ মেডিকেল ফার্মাসিস্ট আলহাজ মোকলেস উদ্দিন (৯০)। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ১৭ জুলাই রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ভর্তি হন তিনি। গতকাল শনিবার ভোর ৫টা ১০ মিনিটে তিনি মারা যান।
ঘটনার পর পরই মৃতের ছেলে সাইদুর রহমান তাঁর বাবার লাশ বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য মাস্তুল ফাউন্ডেশন নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে ফোন করে অনুরোধ করেন।
মাস্তুল ফাউন্ডেশন বিনা খরচে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তিদের দাফন-কাফন সম্পন্ন করে। ফাউন্ডেশন থেকে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক শনিবার বেলা ১১টার দিকে হাসপাতালে যান। দেখেন, করোনা ইউনিট ভবনের লিফটের জায়গা অনেক ছোট। যেখানে স্ট্রেচার ঢোকানো যায় না। ফলে তাঁরা স্ট্রেচার অ্যাম্বুলেন্সে রেখে ভবনটির ছয়তলায় ওঠেন। করোনা ইউনিটে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবীরা দেখেন, লাশটি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউতে) বেডেই রাখা আছে। তখন লাশটি একটি পাতলা কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। কাপড়টি সরালেই সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে যাবে মৃতদেহ।
এই দৃশ্য দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন স্বেচ্ছাসেবকরা। কারণ, তাঁদের সংগঠন এ পর্যন্ত যতগুলো হাসপাতাল থেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির লাশ নিয়েছেন; সব হাসপাতালই লাশ ব্যাগে মুড়িয়ে দিয়েছে। স্বেচ্ছাসেবীরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়ে একটি ব্যাগ দিতে বলেন। কিন্তু হাসপাতাল থেকে তাঁদের জানানো হয়, ‘তাদের ব্যাগ দেওয়ার কোনো সিস্টেম নেই’।
কেন সিস্টেম নেই সংগঠনটির এমন প্রশ্নে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে কর্তৃপক্ষ বলে, ‘আপনারা সব নিয়ে আসেননি কেন? আপনাদের নিয়ে আসা উচিত ছিল।’ এরপর দুই পক্ষের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয় কিছুক্ষণ।
বাকবিতণ্ডার পর মাস্তুল ফাউন্ডেশনের কর্মীদের অপেক্ষা করতে বলা হয় হাসপাতাল থেকে। ৩০ মিনিট পর হাসপাতাল থেকে তাঁদের একটি বিছানার চাদর দেওয়া হয়। কিন্তু ওই চাদরে মৃতদেহ মোড়ানো সম্ভব নয় বলে স্বেচ্ছাসেবকরা লাশের ব্যাগ নিয়ে যান ওপরে। এরপর মৃতদেহ লিফটের মেঝেতে শুইয়ে নিচে নামান। তবে সোজাসুজি শোয়ানোর সুযোগ না থাকায় বাঁকা করে শুইয়ে নিচে নামাতে বাধ্য হন তাঁরা।
আজ রোববার সকালে মাস্তুল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা কাজী রিয়াজ রহমান আসিফ এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। সে সময় তিনি তাঁদের ওই বিড়ম্বনার কথা বলছিলেন। তিনি বলেন, ‘আলহাজ মোকলেস উদ্দিনের লাশটি মানিকগঞ্জ সদরের তাঁর গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দিতে মৃতের ছেলে সাইদুর রহমান আমাকে অনুরোধ করেন। তিনি ভোর ৫টার পর ফোন করেন আমাকে। বেলা ১১টার দিকে আমরা লাশটি নিতে হাসপাতালে যাই। লিফট দিয়ে স্ট্রেচার ওঠানোর চেষ্টা করলাম। পারলাম না। কারণ, লিফট ছোট। ভেতরে জায়গা কম। এরপর স্ট্রেচার নিচে রেখে ওপরে উঠতে বাধ্য হলাম। ওপরে উঠে দেখি লাশটি আইসিইউর বেডে রাখা আছে। কিন্তু আমি অবাক হলাম, লাশটির শরীরে মাত্র একটি কাপড় দিয়ে রাখা হয়েছে। কাপড়টি সরালে লাশটি পুরো উলঙ্গ হয়ে যাবে। উলঙ্গ লাশটিকে আমাদের নিজেদের কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে নিয়ে যেতে বলা হয় কর্তৃপক্ষ থেকে।’
কাজী রিয়াজ রহমান আসিফ বলেন, “তখন আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বললাম, এত টাকা বিল করলেন অথচ একটা ১০০ টাকার কাপড়ও দিতে পারলেন না শরীর ঢাকার জন্য? এই কথার জবাবে হাসপাতাল থেকে জানানো হয়, তাদের সিস্টেমে নেই। তারা দিতে পারবেন না। তখন হাসপাতাল থেকে উল্টা আমাদের দোষারোপ করে বলা হয়, ‘আপনারা (আমরা) কেন সব নিয়ে আসেননি?’ এরপর আমাদের স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের বাকবিতণ্ডা হয়। যত কিছুই হোক, একটা লাশকে এভাবে উলঙ্গ অবস্থায় দিতে হবে কেন? পরে আমাদের বসতে বলা হয়। এভাবে ৩০ মিনিট রিকুয়েস্ট করার পর আমাদের হাতে একটি বেড কভার ধরিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, এই কাপড়ে করে লাশটি নিয়ে যেতে। বেড কভারে লাশ নিয়ে আসা যায়?”
‘পরে নিচে থাকা আমাদের অ্যাম্বুলেন্স থেকে একটি লাশবাহী ব্যাগ নিয়ে যাই ওপরে। লাশটি ওই ব্যাগে আমরাই ঢোকাই। তারপর লিফটে শুইয়ে দিয়ে লাশটিকে আমরা নিচে নামাই। কিন্তু লিফটের ভেতর দিয়ে ঘাড়ে করে অথবা লিফটের মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে লাশ নামানো ছাড়া কোনো সুযোগ নেই। একটা কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের এই অবস্থা মেনে নেওয়া যায়? অথচ আমরা এই পর্যন্ত যতগুলো হাসপাতাল থেকে করোনার লাশ নিয়েছি সবাই আমাদের ব্যাগে মুড়িয়ে লাশ দিয়েছে।’ যোগ করেন মাস্তুল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা।
এই ব্যাপারে আলহাজ মোকলেস উদ্দিনের ছেলে সাইদুর রহমানের সঙ্গেও এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি মুঠোফোনে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমার বাবা রেলওয়ের সাবেক চিফ মেডিকেল ফার্মাসিস্ট ও স্টোরকিপার ছিলেন। করোনায় আক্রান্ত হলে বাবাকে গত ১৭ জুলাই আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে ভর্তি করি। গতকাল শনিবার ভোর ৫টা ১০ মিনিটে তিনি মারা যান। হাসপাতালের মোট বিল আসে চার লাখ ৯৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা নিয়ে আমি অন্তত সন্তুষ্ট ছিলাম না। কারণ সেখানে সব ডাকাত বসে আছে।’
সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমার বাবা ১৯৭৮, ১৯৮০ ও ১৯৮৫ সালে মোট তিনবার হজে গিয়েছিলেন।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এনায়েত বলেন, ‘আমাদের হাসপাতাল কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল। আমাদের জন্য সরকার লাশবাহী ব্যাগও দিয়েছে। সাধারণত ওই ব্যাগে করে লাশ মুড়িয়ে দেওয়ার কথা। পরে এই ঘটনা আমিও শুনেছি। শুনে যারা এসবের তদারকি করেন তাদের কাছে জানতে চাইলাম বিষয়টি সম্পর্কে। দায়িত্বরতরা বললেন, ওই সময় তাদের আশপাশে লাশের ব্যাগ ছিল না। সেজন্য দিতে পারেনি। কিন্তু আশপাশে ব্যাগ থাকবে না এটা হতে পারে না। করোনার জন্য আলাদা ইউনিট আছে আমাদের। সেখানে সব ধরনের ব্যবস্থা আছে। আর লিফটের ব্যাপার সত্য। আমরা তড়িঘড়ি করে কোভিড ইউনিট তৈরি করেছি একটি মার্কেটের ছয়তলায়। ওই ভবনের লিফট ছোট। স্ট্রেচার ঢোকানোর মতো পথ নেই সেখানে।’