ভৈরবে ১০ দিনব্যাপী একুশে বইমেলার উদ্বোধন
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ১০ দিনব্যাপী বঙ্গবন্ধু একুশে বইমেলার উদ্বোধন করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার রাতে ভৈরব বইমেলা পরিষদ আয়োজিত ২৩তম এই বইমেলার উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ভৈরব উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ মো. সায়দুল্লাহ মিয়া, পৌরসভার মেয়র মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ফখরুল আলম আক্কাছ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লুবনা ফারজানা, সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিমাদ্রি খীসা, অধ্যক্ষ জাকির হোসেন, ভৈরব প্রেসক্লাবের সভাপতি মো. জাকির হোসেন কাজল ও সিনিয়র সহসভাপতি এসএম বাকী বিল্লাহ।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ভৈরব বইমেলা পরিষদের সভাপতি আতিক আহমেদ সৌরভ। সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক সুমন মোল্লা। আলোচনা সভার শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন বইমেলা পরিষদের সহসভাপতি অধ্যাপক ফজলুল হক শাহেদ। তিনি তাঁর বক্তব্যে জানান, এবারের ২৩তম বইমেলাটি মুজিববর্ষ উদযাপনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। নামকরণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু একুশে বইমেলা’।
বইমেলাটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নামে উৎসর্গ করা হয়েছে প্রসঙ্গটি টেনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতে হলে আগে আমাদের প্রকৃত মানুষ হওয়ার ব্রত গ্রহণ করতে হবে। কারণ, প্রকৃত মানুষ হওয়া ছাড়া বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গঠনে ভূমিকা রাখা যাবে না। আর প্রকৃত মানুষ হতে হলে বই পড়ার বিকল্প নেই। একটি ভালো বই মানুষের মনের কালিমা দূর করে সেখানে আলোকবর্তিকা জ্বেলে দেয়।’
রামেন্দু মজুমদার এবারের বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও পয়লা ফাল্গুন বসন্ত উৎসব একসঙ্গে উদযাপনে নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখে বেশ আপ্লুত হয়েছেন জানিয়ে বলেন, পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে ষড়ঋতুর আবর্তে প্রকৃতি নব নব রূপে সাজে। আর এই সাজের প্রভাব পড়ে এ দেশের সব বয়সী মানুষের মধ্যে।
এ দেশে বাঙালিসহ বহু ক্ষুদ্র জাতি নৃগোষ্ঠী মিলেমিশে বসবাস করে আসছে উল্লেখ করে এই সাংস্কৃতিক ও নাট্যব্যক্তিত্ব আরো বলেন, ‘এই ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, উৎসব ও সংস্কৃতির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ রাখতে হবে। এদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হবে।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মুক্তিযোদ্ধা সায়দুল্লাহ মিয়া বলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চায় ভাটা পড়ে। এর প্রভাব এসে পড়ে এই ভৈরবেও। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালে নতুন প্রজন্মকে বই পড়ায় উৎসাহিত করতে এই বইমেলা শুরু হয়। দীর্ঘদিন এমন একটি আয়োজন নিয়মিতভাবে সুন্দর ও সুচারুরূপে করে যাওয়ায় আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান তিনি। তিনি এ সময় বেশি বেশি বই পড়তে নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের প্রতি আহ্বান জানান।
পৌর মেয়র ফখরুল আলম আক্কাছ বলেন, ‘একটা সময় ছিল, বইপ্রেমীরা টাকা জমিয়ে ঢাকার বইমেলা থেকে দু-চারটি বই কিনে আনতেন। কিন্তু ঢাকার বইমেলার অনুরূপ এখন এই বন্দরনগরী ভৈরবে। তাই যে কেউ ইচ্ছে করলেই বেশি বেশি বই কিনতে পারেন। গড়ে তুলতে পারেন ব্যক্তিগত বা পারিবারিক গ্রন্থাগার।’
পৌর মেয়র একটি ভালো বইকে একজন উত্তম বন্ধুর চেয়েও মূল্যবান বলে উল্লেখ করে বলেন, বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়লে জ্ঞানের সব শাখা প্রস্ফুটিত হয়।
ইউএনও লুবনা ফারজানা তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘শিক্ষাজীবনে অপেক্ষায় থাকতাম কখন বাংলা একাডেমি চত্বরে প্রাণের বইমেলা শুরু হবে। পছন্দের বই কিনব, হরেক বই দেখব। কর্মজীবনের ব্যস্ততায় বইমেলাকে খুব মিস করতাম। কিন্তু ভৈরব বইমেলা পরিষদ এমন একটি আয়োজন করে আমাকে নতুন বইয়ের গন্ধ নেওয়ার সুযোগটা করে দিল।’ তিনি এই বইয়ের আয়োজনে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব রকম সহযোগিতা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন।
সরকারী জিল্লুর রহমান মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মো. জাকির হোসেন বলেন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীকে উৎসর্গ করায় এবারে বইমেলার মাহাত্ম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি এই জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘আপনারা বইয়ের পাশাপাশি শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার যে পসরা সাজিয়েছেন, তা এই এলাকার নতুন প্রজন্মকে সমৃদ্ধ করবে মেধা ও মননে।’
সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিমাদ্রি খীসা তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘এই বইমেলাকে উপলক্ষ করে এই চত্বরে যে প্রাণের স্পন্দন বাজল, মেলা শেষ হওয়ার পরও এমনটি যেন থাকে এখানকার সাহিত্যানুরাগীদের মধ্যে। বইয়ের আলো আর সংস্কৃতি চর্চার আভা মনকে রাঙিয়ে দিলেই এই আয়োজন সার্থক হবে।’ তিনি তাঁর কার্যালয় চত্বরে ১০ দিনব্যাপী এমন একটি আয়োজনকে বেশ উপভোগ করবেন বলেও উল্লেখ করেন।
সভাপতির বক্তব্যে আতিক আহমেদ সৌরভ বলেন, তিনি চেষ্টা করেছেন আয়োজনটিতে প্রাণচাঞ্চল্যতা দিতে। যেটুকু পেরেছেন, ততটুকু তার পরিষদের সব সদস্যের এবং স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের। এই মেলাকে সার্থক করতে যারা আর্থিক ও শ্রম দিয়ে সহযোগিতা করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
ভৈরব বাজার রাজকাচারি মাঠে আয়োজিত এবারের মেলায় ১৮টি বইয়ের স্টল বসেছে। এসব স্টলে সব বয়সী পাঠকের জন্য বইয়ের সমারোহ ঘটানো হয়েছে জানিয়ে সাধারণ সম্পাদক মো. সুমন মোল্লা জানান, সাত দিনব্যাপী আয়োজন করা গত বইমেলায় ১০ লাখ টাকারও বেশি বই বিক্রি হয়েছিল। এবার স্টলের সংখ্যা এবং মেলার সময় বৃদ্ধি পেয়েছে। সংগত কারণেই বই বিক্রিও বাড়বে উল্লেখ করে তিনি আহ্বান জানান, মেলায় আসা প্রত্যেকে যেনো কম করে হলেও একটি করে বই কিনে নেন।
সুমন মোল্লা আরো জানান, প্রতিদিন মেলামঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মীদের অংশগ্রহণে নাচ, গান, আবৃত্তি ও নাটক। এ ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে থাকবে প্রতিযোগিতামূলক বিভিন্ন অনুষ্ঠান। মেলা প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চলবে।