ভৈরবে হারিয়ে যাচ্ছে হাতেভাজা মুড়ি
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে মিলেভাজা মুড়ির দাপটে বিলপ্ত হয়ে পড়েছে গ্রাম-বাংলার সুপ্রাচীন ঐতিহ্য হাতে ভাজা মুড়ি। ফলে এই কাজের সঙ্গে জড়িত থাকা শত শত পরিবারে এখন নেমে এসেছে চরম দুর্দশা। কর্মহীন হয়ে অনেকে আর্থিক দৈন্যতায় দিন যাপন করছে।
জানা যায়, একটা সময় ভৈরবের রামশংকরপুর, কমলপুর গাছতলাঘাট, আমলাপাড়াসহ হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে হাতেভাজা মুড়ি তৈরি হত। আর সুস্বাদু এইসব মুড়ির কদর ও খ্যাতি ছিল ভৈরবসহ আশেপাশের এলাকাতেও। বিভিন্ন এলাকার লোকজন মুড়ি কিনতে ছুটে যেতেন এইসব গ্রামে। সে সময় অনেক মুড়ির কারিগর ফেরি করে তাদের মুড়ি বিক্রি করতেন গ্রাম ও শহর এলাকায়।
এ ছাড়া ভৈরব বাজার এলাকায় মুড়িপট্টি নামের এলাকায় রাস্তার উপর চটের বস্তায় ভরে মুড়ি নিয়ে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। লোকজন চাহিদা মতো তাদের গরম মুড়ি কিনে নিতেন তাদের কাছ থেকে।
রমজানতো বটেই, সারা বছর কদর ছিল এ মুড়ির। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের সারা বছরই ব্যস্ত সময় কাটত। ব্যাপক চাহিদা থাকায় এ কাজ করে সংসারও চলত স্বচ্ছলভাবে। কিন্তু বর্তমানে মিলের ভাজা মুড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে এ কর্ম বিলুপ্তপ্রায়। ফলে কর্ম হারিয়ে এখন অনেকেই বেকার জীবন যাপন করছেন। কেউ কেউ নিজেদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে টিকে আছেন নামকাওয়াস্তে।
পঞ্চাশ বছর আগে সত্তর বছর বয়সী সুরধ্বনী রানী বিশ্বাসের বিয়ে হয় ভৈরবের রামশংকরপুর গ্রামের স্বর্গীয় মনিদ্র বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি বউ হয়ে এসে দেখেন এ গ্রামের ঘরে ঘরে সবাই মুড়ি ভাজার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তিনি নিজেও এ কাজ রপ্ত করেন। সে সময় মুড়ি ভেজে তাদের বেশ লাভ হতো। কিন্তু মিলে মুড়ি ভাজা শুরু হলে ধীরে ধীরে তাদের হাতের ভাজা মুড়ির কদর কমতে থাকে।
এখনও তিনি মুড়ি ভাজেন। তবে লাভ তেমনটা হয় না। সুরধ্বনী বিশ্বাসের ভাষায় ‘লাইগ্যা থাকলে, মাইগ্যা খায় না’-এই কারণে মুড়ি ভাজার কাজে এখনো লেগে আছেন। ঠিক একই রকম কথা জানালেন ওই গ্রামের বীণা রানী বিশ্বাস, লক্ষ্মী রানী বিশ্বাস, দোলন রানী বিশ্বাস, শোভা রানী বিশ্বাস ও শিখা রানী বিশ্বাসসহ আরও কয়েকজন। মিলের মুড়ি তাদের মুড়ির চেয়ে দামে কম হওয়ায়, তাদের মুড়ির চাহিদা কমে গেছে বলে জানালেন তারা।
নিজেদের গ্রামের হাতে ভাজা মুড়ি কারিগরদের ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরে স্থানীয় বাসিন্দা মজনু মিয়া, রফিকুল ইসলাম ও হাজী হারুন মিয়া জানান, মিলে ভাজা মুড়ির উৎপাদন খরচ কম হওয়ায়, বাজারে বিক্রি হয় কম দামে। অপরদিকে হাতে ভাজা মুড়ি তৈরিতে খরচ বেশি হওয়ায় বিক্রিও করতে হয় বেশি দামে। তাই তাদের মুড়ির চাহিদা কমে গেছে। এ গ্রামের মুড়ি কারিগররা আগে সচ্ছল জীবন যাপন করলেও এখন অভাব অনটনে তাদের দিন কাটছে। গ্রাম-বাংলার প্রাচীন এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ জানান তারা।