ভৈরবে পরিত্যক্ত পলিথিন থেকে উৎপাদন হচ্ছে জ্বালানি তেল
কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলায় পরিত্যক্ত পলিথিন বর্জ্য থেকে তৈরি হচ্ছে ডিজেল, পেট্রল ও গ্যাস। দেশের পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি এই পলিথিন থেকে রক্ষা পাওয়ার এমন উদ্যোগে বেশ খুশি স্থানীয় লোকজন, জনপ্রতিনিধিসহ উপজেলা প্রশাসন। তাঁরা প্রত্যেকেই যার যার অবস্থান থেকে উদ্যোক্তাকে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লুবনা ফারজানাসহ অন্যান্য অতিথি গত ৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আহিল পেট্রোলিয়াম লিমিটেড’ নামে একটি শিল্পকারখানার উদ্বোধন করেন। সেখানে বর্তমানে প্রতিদিন ১৬০ কেজি পরিত্যক্ত পলিথিন পুড়িয়ে উৎপাদন হচ্ছে ১০০ কেজি জ্বালানি তেল।
বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজ ও দেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে পলিথিন বর্জ্য। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পলিব্যাগ ও পলিপ্যাকেট অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ হওয়ায় এসব থেকে মুক্তি মিলছে না। আবার পলিথিন ও প্লাস্টিক যত্রতত্র ফেলে দেওয়ার কারণে এবং সহজে পচনশীল না হওয়ায় আমাদের চারপাশের নদী-নালা, খাল-বিলসহ ড্রেনেজ ব্যবস্থা ধ্বংসের মুখে। জমির উর্বরতা শক্তিসহ নানাভাবে চারপাশের ভূমিকে হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে এসব পলিথিন ও প্লাস্টিক।
এই হুমকি থেকে সামাজিক পরিবেশ রক্ষায় এবং পেট্রল, ডিজেল ও গ্যাসের মতো সম্পদ উৎপাদনসহ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার মতো এই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অগ্রযাত্রাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন স্থানীয়রা। সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক উপায়ে পরিত্যক্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক থেকে জ্বালানি তেল ও গ্যাস উৎপাদন দেখতে প্রতিদিন হাজারও মানুষ ভিড় করছেন আহিল পেট্রোলিয়াম নামে নতুন এই শিল্পকারখানায়।
কারখানাটির উদ্যোক্তা ইউসুফ আহমেদ গালিব জানান, ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে এই প্রকল্পটির কাজ শুরু করেন তিনি। থাইল্যান্ড ব্যাজ সেপকো কোম্পানির প্যাটার্ন অনুযায়ী, বাংলাদেশের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন—এটুআইর দিকনির্দেশনায় এবং বাংলাদেশ শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) সম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনায় এই প্রকল্প শুরু করেন তিনি। থাইল্যান্ড বর্তমানে ফিফথ জেনারেশনে কাজ করছে। আর গালিব শুরু করেছেন প্রথম জেনারেশনে।
বর্তমানে কারখানাটিতে প্রতিদিন ১৬০ কেজি পরিত্যক্ত পলিথিন পুড়িয়ে ১০০ কেজি জ্বালানি তেল সংগ্রহ করা হচ্ছে। যার মধ্যে পেট্রল, ডিজেল ও গ্যাস আছে। তবে বর্তমানে গ্যাস সংগ্রহ না করে কারখানায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
পলিথিনকে সামাজিক পরিবেশ, মাটি, পানি ও বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ উল্লেখ করে গালিব জানান, পলিথিন বর্জ্যকে উচ্চমাত্রায় হিট দেওয়ার ফলে পলিথিনের হাইড্রোকার্বনের চেইন ভেঙে যায়। হাইড্রোকার্বনের চেইন ভেঙে যাওয়ার ফলে লিকুইড গ্যাস তৈরি হয়। সেই লিকুইড গ্যাস ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হওয়ার পর প্রতিটি চেম্বার থেকে কলিন কনডেনসারে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে পেট্রল ও ডিজেল আলাদা হয়ে যায়। পেট্রল ও ডিজেল আলাদা হয়ে যে গ্যাসটা থাকে, সেটি ওয়াটার ফিল্টারের মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে চেম্বারের যে জ্বালানির জায়গা আছে, সেখানে গিয়ে জমা হয়।
গালিব আরো জানান, পলিথিন থেকে জালানি তেল উৎপাদন প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় পাইরোলাইসিস প্রসেস। এ প্রক্রিয়ায় পলিথিন বা প্লাস্টিককে উচ্চ তাপমাত্রায় বিক্রিয়া ঘটিয়ে পলিথিনের অণুগুলো আলাদা করা হয়, যার মাধ্যমে তরল গ্যাস উৎপন্ন হয়। এই তরল গ্যাস আস্তে আস্তে তাপমাত্রা হ্রাস হওয়াতে ঘনীভূত হতে শুরু করে। নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় পৌঁছানোর পর এই তরল গ্যাস প্রথমে পেট্রল ও পরে ডিজেলে পরিণত হয়ে আলাদা আলাদা পাত্রে জমা হতে থাকে। অবশিষ্ট তরল গ্যাস পরিশোধিত হয়ে জ্বালানি গ্যাসে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়ায় এক কেজি পলিথিন থেকে প্রকারভেদে ৩০০ থেকে ৪০০ মিলিলিটার ডিজেল ও ২৫০ থেকে ৩০০ মিলিলিটার পেট্রল উৎপাদন হয়। প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হওয়ার পর অবশিষ্টটুকু সংগ্রহ করা হয় এবং এগুলো ছাপা কালিতে পরিণত করা যায়। প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ চলমান একটি প্রক্রিয়া। তাই এতে গ্যাস জমে দুর্ঘটনা ঘটার তেমন কোনো আশঙ্কা নেই।
বর্তমানে কারখানাটিতে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ১৬০ কেজি পরিত্যক্ত পলিথিন থেকে ৪০ থেকে ৫০ কেজি ডিজেল ও ২৫ থেকে ৩০ কেজি পেট্রল এবং ৩০ থেকে ৩৫ কেজি কালি উৎপাদন হচ্ছে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে সাত থেকে আট ঘণ্টা সময় লাগে। আর এই পরিমাণ উৎপাদনে সর্বমোট উৎপাদন খরচ হয় চার হাজার ৬০০ টাকা। আর উৎপাদিত জ্বালানি বিক্রি করে আয় হয় সাত হাজার টাকারও বেশি। ফলে খরচ বাদে প্রতিদিন নিট মুনাফা থাকছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। তবে প্রজেক্ট ভালোভাবে চলমান হওয়ার পর উৎপাদন খরচ আরো কমে মুনাফার পরিমাণ আরো বেশি হবে বলে জানান গালিব।
ইউসুফ আহমেদ গালিব জানান, তিনি পরবর্তী সময়ে তাঁর কারখানাটি আরো বৃহৎ পরিসরে গড়ে তুলবেন। সেখানে প্রতিদিন দেড় টন জ্বালানি তেল উৎপাদন করা সম্ভব বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) মান নির্ণয়ের ফলাফলে পলিথিন থেকে উৎপাদিত এই জ্বালানি তেলের মান হচ্ছে ৯৩.৫৬। যার সাধারণ জ্বালানি থেকে ১.৫৬ শতাংশ জ্বালানিক্ষমতা বেশি এবং পুরোপুরি লো-কার্বনের জ্বালানি। আর এই জ্বালানি পরিবেশের জন্য সম্পূর্ণ ক্ষতিমুক্ত।
আহিল পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের উদ্যোক্তা আরো জানান, উন্নত বিশ্বের বহু দেশে এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিকল্প জ্বালানি তেল উৎপাদিত হচ্ছে। তিনি প্রথমে ২০১৮ সালে পরীক্ষামূলকভাবে প্রকল্পটি গ্রহণ করে সফল হন। পরে বিসিএসআইআরে উৎপাদিত নমুনার গুণগতমান পরীক্ষার পর আশাব্যঞ্জক রিপোর্ট পেয়ে গত বছরের আগস্ট থেকে স্বল্প পরিসরে উৎপাদন শুরু করে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করছেন তিনি।
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পরিচালিত অ্যাকসেস টু ইনফরমেশনের দিকনির্দেশনায় এবং বিসিএসআইআরের মান নির্ণয়ের ভিত্তিতে পরিত্যক্ত পলিথিন থেকে বাণিজ্যিকভাবে জ্বালানি তেল ও গ্যাস উৎপাদনের জন্য আহিল পেট্রোলিয়াম লিমিটেড নামের এ প্রতিষ্ঠান শুরু করেছেন গালিব। এ প্রকল্পের মাধ্যমে পরিত্যক্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক থেকে মাটি, পানি ও বায়ুদূষণের পরিমাণ হ্রাস করে জ্বালানি তেল উৎপাদনের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিকে ত্বরান্বিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
পলিথিনকে বাংলাদেশের জন্য সমস্যা উল্লেখ করে এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য উদ্যোগটিকে স্বাগত জানান ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লুবনা ফারজানা। তিনি এর আইনগত অনুমোদন এবং আরো বড় পরিসরে কাজটি করতে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
এক সমাবেশে উপস্থিত নারীদের উদ্দেশ করে লুবনা ফারজানা বলেন, ‘আজ থেকে আপনারা ঘরে ঘরে দুটি করে ঝুড়ি রাখবেন। একটি ময়লা আর অপরটিতে পলিথিন জাতীয় দ্রব্য। আর এই পলিথিনের ঝুড়িগুলো আহিল পেট্রোলিয়ামের লোকজন গিয়ে নিয়ে আসবেন। এতে করে আপনারা সবাই লাভবান হবেন। আর আমাদের চারপাশের পরিবেশ হবে দূষণমুক্ত।’
কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মির্জা মো. সুলায়মান বলেন, ‘পরিবেশবান্ধব এমন একটি শিল্পকারখানা গড়ে তোলায় উদ্যোক্তা ইউসুফ আহমেদ গালিবকে ধন্যবাদ জানাই। আশা করি, ভৈরব পৌর কর্তৃপক্ষ পলিথিন বর্জ্য সরবরাহ করে কারখানাটিকে সহযোগিতা করবে। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের প্রতিদিনের সংগ্রহ করা পলিথিন বর্জ্য এই কারখানা কর্তৃপক্ষকে সরবরাহ করার উদ্যোগ নিলে কারখানাটি যেমন তার কাঁচামাল পাবে, পৌর কর্তৃপক্ষও পলিথিন বর্জ্য ধ্বংস করার একটা উপায় পাবে।’
স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর আরেফিন জালাল রাজিব সওদাগর তাঁর ওয়ার্ডে এমন একটি কারখানা গড়ে ওঠায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তাঁর পক্ষ থেকে কারখানা কর্তৃপক্ষকে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
সমাজকর্মী মাহিন ছিদ্দিকী ও ইকরাম বক্স বলেন, পলিথিন বর্জ্য আমাদের চারপাশের পরিবেশকে প্রতিদিন যেভাবে দূষণ করছে, তা ভয়াবহ। নদী-নালা, খাল-বিল, ভূমি ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে এক ভয়ংকর হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আমরা যখন এই ভয়াবহতা থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজছিলাম, তখন এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।
এ দুই সমাজকর্মী আরো জানান, এই প্রক্রিয়ায় শুধু পলিথিন বর্জ্য ধ্বংসই হবে না, উৎপাদিত হবে জ্বালানি ও গ্যাসের মতো মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ।
ক্যাপশন ২
ভৈরবে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানা আহিল পেট্রোলিয়াম লিমিটেড। ছবি : এনটিভি