ভাসানচরে রোহিঙ্গারা নিরাপদে আছে : বিশেষজ্ঞদের অভিমত
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ভাসানচর ভূতাত্ত্বিকভাবে স্থিতিশীল এবং পৃথিবীর যেকোনো শরণার্থী শিবিরের চেয়ে ভাসানচর টেকসই এবং নিরাপদ। মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মধ্যে যাদের কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হচ্ছে, তারা দ্বীপে নিরাপদে আছে। তবে, চিকিৎসা ও বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে খানিকটা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এ ছাড়া কর্মসংস্থান বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর ইস্যুতে একটি গবেষণায় উঠে এসেছে এসব তথ্য।
২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় কক্সবাজারে। সবমিলিয়ে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ পর্যটননগরী কক্সবাজারের ৩৪টি ক্যাম্পে। যে কারণে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের আবাসনের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে গত তিন মাসে প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থানান্তর করেছে। পর্যায়ক্রমে মোট এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলমান। কিন্তু এরই মধ্যে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে- বসবাসের জন্য ভাসানচর কতটা টেকসই।
এমন পরিপ্রেক্ষিতে, ‘বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর : সুবিধা এবং প্রতিকূলতা’ শিরোনামে গত প্রায় তিন মাস গবেষণা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগ এবং সেন্ট্রাল ফাউন্ডেশন ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে গতকাল শনিবার এক সেমিনারে তুলে ধরা হয় ওই গবেষণার তথ্য উপাত্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপ-উপাচার্য এবং দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল সেমিনারে বলেন, ‘ভূতাত্ত্বিকভাবে এই দ্বীপ (ভাসানচর) স্থিতিশীল… ভাসানচর রোহিঙ্গাদের জন্য একটি নিরাপদ এলাকা।’
সেন্ট্রাল ফাউন্ডেশন ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (সিএফআইএস) সহযোগিতায় ডিইউ-এর শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ ‘কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর : সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করে।
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় ড. কামাল বলেন, ভাসানচরের জীবনযাত্রা কক্সবাজার শিবিরের চেয়ে ভালো। এই দ্বীপে রোহিঙ্গা শিশুদের সংগঠিতভাবে শিক্ষা সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরের তুলনায় ভাসানচরে জীবিকার সুবিধা ভালো। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. কামাল বলেন, ভূতাত্ত্বিক দিক বিবেচনা করে তাঁর নেতৃত্বে একটি গবেষক দল গত কয়েক মাসে ভাসানচরের ওপর একটি গবেষণা চালিয়ে জানতে পারেন দ্বীপটি স্থিতিশীল কি না। ভাসানচর দ্বীপটি প্রায় ১৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। তিনি আরও বলেন এই দ্বীপটি ভাঙনের আশঙ্কা কম। তিনি বলেন, মেঘনা নদী দিয়ে প্রতি বছর প্রায় দুই বিলিয়ন টন ময়লা নেমে বঙ্গোপসাগরে জমা হচ্ছে। এই দ্বীপ দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে এবং ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছে একদিন ভাসানচর সন্দ্বীপের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে ড. কামাল বলেন, ভাসানচরের ১২০টি গুচ্ছগ্রামে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে, যা দুর্যোগে বিপর্যয় কমাতে সাহায্য করবে। ভাসানচরে আন্তর্মহাদেশীয় এবং স্থানীয় সুনামির কোনো সম্ভাবনা নেই এবং এ কারণে এটি রোহিঙ্গাদের জন্য একটি নিরাপদ এলাকা।
ড. কামাল বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাস্ত্যুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের আশ্রয় দিয়ে তার উদারতা দেখিয়েছেন এবং ‘মানবতার মায়ের’ মর্যাদা অর্জন করেছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ানোর আহ্বান জানান।
সিএফআইএসএস-এর চেয়ারম্যান কমোডোর এমএন আবসার বলেন, যখন উন্নত দেশগুলো রোহিঙ্গাদের প্রবেশের কথা অস্বীকার করে, তখন বাংলাদেশ মানবিক বিবেচনায় তাদের আশ্রয় দেয়। কিন্তু, তারা বিভিন্ন হুমকি দিচ্ছে। একটি বাসযোগ্য অবস্থা পেতে আরও রোহিঙ্গা কক্সবাজার শিবির থেকে স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে আগ্রহী। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার আগে তাদের একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করা উচিত।
দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান বলেন, বঙ্গোপসাগরে ময়লা জমা হচ্ছে এবং ভাসানচরকে কিছু প্রকৌশল ব্যবস্থা গ্রহণ করে স্থিতিশীল রাখা যেতে পারে। ভাসানচরের চারপাশে এরই মধ্যে নয় ফুট উঁচু একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে এবং ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে দ্বীপটিকে রক্ষা করতে এর উচ্চতা ১৯ ফুটে উন্নীত করা হবে।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. সাদেকা হালিম, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন উন্নয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন সেমিনারে বক্তব্য রাখেন।
শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন উন্নয়নের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. তৌহিদুল ইসলাম একটি গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন।