ভালোবাসা-শ্রদ্ধায় ভাষা শহীদদের স্মরণ
ভালোবাসা ও গভীর শ্রদ্ধায় ভাষা শহীদদের স্মরণ করেছে সর্বস্তরের মানুষ। শিশু, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী কিংবা বয়স্ক; সব ধরনের মানুষ আজ রোববার রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যায় ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।
পুরো শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ শ্রদ্ধা আর সম্মান প্রদর্শনের অনন্য নিদর্শন হয়ে ওঠে। শ্রদ্ধা নিবেদন করতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সর্বস্তরের মানুষ। সাদা কালো পোশাকে ভরে ছিল পুরো প্রাঙ্গণ।
এই যেমন শিশু নাদিয়া জাহান তার বাবা মফিজুল ও মা নাসিমা সুলতানার সঙ্গে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসেছে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। সবাই শহীদ মিনারের নিচের সিঁড়িতে ফুল দেয়। শহীদ মিনারের বেদিতে উঠতে না পেরে কান্না শুরু করে দেয় নাদিয়া। নাছোড়বান্দা নাদিয়া, বেদিতে যাবেই।
নাদিয়ার কান্না দেখে এগিয়ে আসেন সেখানে দায়িত্বরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক স্বেচ্ছাসেবক। জানতে চান, ‘মা, তুমি ওপরে যেতে চাও? বেদিতে কাউকেই যেতে দেওয়া হচ্ছে না। তবু চলো, তোমাকে নিয়ে যাই।’ এ কথা শুনেই হেসে ওঠে নাদিয়া। বাবার হাত ছেড়ে উঠে যায় বেদিতে। বেদিতে একটি গোলাপ দিয়ে নেমে যায় হাস্যোজ্জ্বল নাদিয়া।
সকাল ১০টার দিকে বেদি থেকে নেমে নাদিয়া জানাল, মূল বেদিতে উঠে সে আনন্দ পেয়েছে। তার বাবা তাকে বলেছিল, বেদিতে উঠাবে। সেই প্রসঙ্গ টেনে নাদিয়া বলল, ‘এখানে না উঠলে মন খারাপ হতো।’ তার খুব ভালো লাগছে জানিয়ে নাদিয়া বলে উঠল, ‘ভালোবাসি বাংলা।’
নাদিয়ার এই দৃশ্য দেখে পাশে থাকা আরো চারজন শিশু যেতে চাইল বেদিতে। ওই স্বেচ্ছাসেবককে শিশুরা জানাল, তারা ওখানে যেতে চায়। এদিকে ওদিকে তাকিয়ে তাদেরও ওপরে নিয়ে যান তিনি। শিশুরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় শহীদ ভাষাসৈনিকদের। স্বেচ্ছাসেবক একে একে তাদের ছবিও তুলে দেন। পরে তারাও খুশিতে নেমে যায় মূল বেদি থেকে।
চারজনের একজন ফাহিম আহম্মেদ। ফাহিম বলল, ‘শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসে খুব ভালো লেগেছে। গত বছরও বাবার সঙ্গে এসেছিলাম। আগামীবারও আসব।’
ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা হামিদ সরদার। তিনি একাই এসেছিলেন ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বললেন, ‘আমার মায়ের ভাষার জন্য প্রাণ দিলেন অনেক ভাষা সৈনিক। আমার শরীরটা খুব একটা ভালো না। অসুস্থতা ভুলে চলে এলাম পবিত্র শহীদ মিনারে।’
আজকের এই আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু হয় গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতের আলপনা আঁকাআঁকির মধ্যে দিয়ে। ২০ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ গতকাল রাত থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় আইনশৃঙ্খরা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা বলয় দেখা গেছে। ওই এলাকার প্রতিটি ইঞ্চি ছিল সিসি ক্যামেরার আওতায়। ছিল তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
শনিবার রাতে শাহবাগ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র ছাড়া কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি ক্যাম্পাসের ভেতরে। আজও সেই নিরাপত্তা বলয় বহাল ছিল। তবে আজ সাধারণ মানুষের জন্য পলাশীর মোড় দিয়ে ঢোকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল শহীদ মিনারে। হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেছিল ভাষাসৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।
করোনার কারণে এবার একটু ভিন্ন ধারায় স্বল্প পরিসরে লোকজন আসে শ্রদ্ধা জানাতে। পুলিশ কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করতে সর্বোচ্চ পাঁচজন আসার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক লোকজনকে শহীদ মিনারে আসতে দেখা গেছে। এ ছাড়া পুলিশ মাস্ক ছাড়া পলাশীর মোড় দিয়ে কাউকে ঢুকতে না দিলেও শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে দেখা গেছে, অনেকের থুতনির নিচে মাস্ক। কারো কারো মুখে বা থুতনির নিচে মাস্কই দেখা যায়নি।