বায়ান্ন বাজার তেপান্ন গলিতে সাকরাইনের মাতামাতি
ইট, কাঠ আর পাথরের শহরে উৎসবের আমেজ। এই আমেজ জন্ম দিয়েছে এক নান্দনিক আবহের! বাড়ির ছাদে বাচ্চাদের লাফালাফি, ঘুড়ি উড়ানো আর সুতা কাটাকাটির প্রতিযোগিতায় ভরা এক আনন্দের সমারোহ।
পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি বাড়ির ছাদ সাজানো-গোছানো। আলোকসজ্জা করা হয়েছে। উচ্চস্বরে বেজে চলেছে বাংলা গান আর কাওয়ালি। এরই মধ্যে মিশে যাচ্ছিল ঘুড়ির সুতা কাটার প্রতিযোগিতায় আনন্দ, চিৎকার। যার ঘুড়ির সুতা কাটা হয়েছে আনন্দে সেও চিৎকার করছে!
বাড়ির ছাদ থেকে ঘুড়ির সুতা কাটার আনন্দে চিৎকার করে এক তরুণ বলছেন, ‘বাকাট্টা-বাকাট্টা ধর-ধর ঘুড়ি ধর’।
এ উৎসবকে কেউ কেউ বলে পৌষ সংক্রান্তি, কেউবা বলে সাকরাইন উৎসব। এই উৎসবে এবার নতুন মাত্রা যোগ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি এই উৎসবের উদ্বোধন করেন।
আয়োজন অনুযায়ী, ঘুড়ি উড়ানোর মতো মানুষ কমই চোখে পড়েছে। প্রত্যেকেই অপেক্ষা করছিলেন, সন্ধ্যার আতশবাজি ও আগুন খেলার জন্য। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে আতশবাজিতে মেতে উঠেন পুরান ঢাকার বাসিন্দারা।
সাকরাইন উৎসবের উদ্বোধন শেষে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ঢাকার ঐতিহ্যকে লালন করা, সংরক্ষণ করা এবং তা পালন করা। সেই লক্ষ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এখন থেকে প্রত্যেক বছর এই উৎসবের আয়োজন করবে। এর মাধ্যমে আমরা ঢাকার সংস্কৃতিকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরতে পারব।’
মেয়র আরো বলেন, ‘এই প্রথম ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ঘুড়ি উৎসব করা হচ্ছে। আমরা এই উৎসব ঢাকাব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। ঢাকা দক্ষিণ সিটির আওতায় আজকে ৭৫টি ওয়ার্ডে ঘুড়ি উৎসব করা হচ্ছে। আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে পুরো ঢাকাবাসী তা উপভোগ করছে। দৃশ্যটি বেশ উপভোগ্য।’
মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘করোনা আমাদের গত মার্চ থেকে অনেক ক্ষতি করেছে। তার মধ্যেও যে আমরা উৎসব করতে জানি, আনন্দ করতে জানি; তা সাকরাইন উৎসবের মাধ্যমে আমরা বিশ্বব্যাপী জানাতে চাই।’
পুরান ঢাকার পাতলা খান লেনে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন ডিএসসিসির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের স্ত্রী ও ছেলে। তাঁরাও উপভোগ করেন সাকরাইন উৎসব। সে সময় মেয়র ও তাঁর স্ত্রী ঘুড়ি উড়ান। ছেলের হাতেও দেন ঘুড়ির নাটাই।
পৌষ সংক্রান্তি যেভাবে সাকরাইন উৎসব
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এই সাকরাইন উৎসবকে পৌষ সংক্রান্তি বা ঘুড়ি উৎসব বলেও বর্ণনা করা হয়। পঞ্জিকা অনুযায়ী, পৌষ মাসের শেষ দিনে এই সাকরাইন উৎসব আয়োজন করা হয়। তবে বাংলা ক্যালেন্ডার ও পঞ্জিকা তারিখের সঙ্গে কিছুটা পার্থক্যের কারণে প্রতিবছর দুদিনব্যাপী এই উৎসবটি পালন করে বায়ান্ন বাজার তেপান্ন গলির বাসিন্দারা। এটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠান হলেও বহু বছর ধরে পুরান ঢাকায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাড়ম্বরে পালিত হয়ে আসছে সাকরাইন উৎসব।
পুরান ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা হাজি মোক্তার আহমেদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এই উৎসবকে পৌষ সংক্রান্তি বলে। আমরা ঢাকাইয়ারা বলি সাকরাইন। দুইটা একই। হিন্দুদের মধ্যে পূজার বিষয়টা আছে, মুসলমানদের মধ্যে সেটা নেই।’
এই উৎসবকে কেন্দ্র করে এক সপ্তাহ ধরে পুরান ঢাকার রাস্তা, অলিগলি আর খোলা ছাদে চলে সুতা মাঞ্জা দেওয়ার কাজ। রোদে সুতা শুকানোর কাজও চলে পুরোদমে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উৎসবের ধরন অনেকটা বদলে গেছে বলে অভিমত এলাকাবাসীর।
পুরান ঢাকার বৃদ্ধ রাশেদ হাসান বলেন, ‘আমার বয়স ৭২ বছর। ছোটবেলায় দেখেছি, আমাদের এই ফরাশগঞ্জ এলাকা ছিল বাঙালি সংস্কৃতির একটা কেন্দ্রবিন্দু। এখানে যে জমিদার বাড়িগুলো ছিল সেই বাড়িগুলোতে ঘুড়ি উৎসব হতো, তাদের নাটাইগুলো ছিল চান্দির বানানো। আর সাধারণ মানুষ বাঁশ দিয়ে বানানো নাটাই দিয়েই ঘুড়ি উড়াত। সেই রকম ঘুড়ি উড়ানো এখন দেখি না। অনেক পরিবর্তন হয়েছে, এখন জৌলুস বেড়েছে, নানারকম জিনিস এসে ঢুকেছে। অরজিনালটা হারিয়ে যেতে বসেছে।’
‘ঘুড়ির যে কাটাকাটির ব্যাপার সেটার জন্য তো আসলে বড় জায়গা লাগে। বড় মাঠ লাগে। ঢাকার মানুষ এখন তো সেরকম মাঠ পায় না, তারা এখন ছাদে ছাদে ঘুড়ি উড়ায়। আর এখানেই আনন্দের বিষয়টা কমে যায়’, যোগ করেন রাশেদ হাসান।