বাসে যাত্রী ও ভাড়া দুটোই বেশি
বাসচালকের সহকারী রহিমের সঙ্গে ভীষণ বাগ্বিতণ্ডা চলছে আবদুস সালামের। আর বাসের সবাই তাকিয়ে আছেন তাঁদের দুজনের দিকে। বেশির ভাগ যাত্রীই অবস্থান নিয়েছেন সালামের পক্ষে। অন্যদিকে, রহিমের পক্ষে শুধু কথা বলছেন বাসের চালক মো. জহির। একপর্যায়ে বাগ্বিতণ্ডা রূপ নেয় হাতাহাতির পর্যায়ে। পরে সবাই মিলে সামলান এ দুজনকে।
বাগ্বিতণ্ডার বিষয়ে আবদুস সালামের যুক্তি, তিনি ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের সাইনবোর্ডসংলগ্ন সাদ্দাম মার্কেটের সামনে থেকে লাব্বাইক বাসে উঠেছেন। নামবেন রাজধানীর কারওয়ান বাজারে। করোনাকালের নির্ধারিত ভাড়া মেনেই তিনি দুই সিটের ভাড়া দিয়েছেন ৫৫ টাকা। তাহলে কেন তিনি পাশের সিটে আরেকজন যাত্রী বসতে দেবেন? যদি বসতেই দিতে হয়, তাহলে সবাই করোনাকালের আগের নির্ধারিত ৩৫ টাকা ভাড়া দেবেন। নিয়ম ভেঙে সব সিটে দুজনই যদি বসানো হয়, তাহলে কেন বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে?
রহিমের পাল্টা যুক্তি, ভাড়া বেশি তো সরকারই নির্ধারণ করেছে। মানুষকে বাসে উঠতে না দিয়ে তিনি গন্তব্যে পৌঁছাবেন কীভাবে? বাসে উঠতে দিলে তাঁদের দোষ, না নিলেও দোষ। সামনের স্ট্যান্ডে একজন নেমে যাবেন, তাই আরেকজনকে তুলেছেন তিনি। সামনের স্ট্যান্ডে যে লোক পাওয়া যাবে, তার গ্যারান্টি কী?
তবে সবার সামনে যখন রহিমের যুক্তি টিকল না, তখন রহিম উচ্চ স্বরে বলে উঠলেন, ‘পাবলিক বাসে উঠে এত গ্যাঞ্জাম করা যাবে না। ভালো না লাগলে নেমে যান। বাসে ওঠার লোকের অভাব নাই।’
আবদুস সালাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘পাশাপাশি যদি দুজনকেই বসতে হয়, তাহলে ভাড়া ৩৫ টাকা দেব। এই সিস্টেমই উঠিয়ে দেওয়া উচিত। কারণ, বাসের লোকজন নিয়ম মানছেন না। না হলে পরিবহনে সঠিক নির্দেশনা ও তা বাস্তবায়নে তাগিদ থাকা দরকার।’
লাব্বাইক বাসের মতো রাজধানীর বিভিন্ন রুটের অনেক বাসের অবস্থা একই রকম। তবে কেউ কেউ যে নিয়ম মানছে না, তা নয়। সদরঘাটের ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে প্রতিদিন কারওয়ান বাজার পর্যন্ত যাতায়াত করেন মৃগাঙ্ক বোস। তিনি বলেন, ‘আমি প্রতিদিন তানজিল পরিবহন বা বিহঙ্গ বাসে উঠি। করোনাকালের নিয়ম অনুযায়ী, বাসের সব সিট ভর্তি। মানে, একেকজনের দুই সিট করে। কিন্তু বাসে অন্তত পাঁচ থেকে সাতজন যাত্রী বেশি তোলা হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে যাত্রী পরে ওঠেন, তিনিও বসতে চান। কারণ, তার কাছ থেকেও পুরো ভাড়া নেওয়া হয়। আবার যে যাত্রী আগে থেকে বসে ছিলেন, তিনিও দুই সিটের ভাড়া দিয়েছেন। কখনো কখনো দুই যাত্রীর মধ্যে মারামারির ঘটনাও ঘটে। আর বেশি লোক তোলা নিয়ে যাত্রীর সঙ্গে চালকের সহকারীর ঝগড়া তো নিয়মিত ঘটনাই।’
হিমু আক্তার নিয়মিত মোহাম্মদপুর থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত যাতায়াত করেন। তিনি বলেন, ‘মেয়ে হওয়ায় বেশির ভাগ সময় বাসে উঠতে দিতে চায় না হেলপার। সে জন্য কখনো ভেঙে ভেঙে যাই, কখনো মোহাম্মদপুর থেকে সোজা চলে যাই। সেদিন আসাদগেট থেকে ৮ নম্বর বাসে উঠলাম। আগে ভাড়া ছিল পাঁচ টাকা। কিন্তু এখন কারওয়ান বাজার পর্যন্ত ভাড়া নিল ১৫ টাকা। পুরো বাসের প্রতি সিটে দুজন করে লোক। স্বাধীন বাসে উঠলে ১০ টাকার ভাড়া ১৫ টাকা দিতে হয়, অথচ লোক থাকে বেশি। তালুকদার বাসে কলেজগেট থেকে ২০ টাকা দিয়ে যেতে হয় কারওয়ান বাজার। বেশির ভাগ বাসেই নিয়ম অনুযায়ী সিট ছাড়া মানুষ বেশি। তা ছাড়া চালক-হেলপার কারো মুখেই বেশির ভাগ সময় মাস্ক থাকে না।’
এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বাস মালিকদের কাছে আমরা জিম্মি। তাঁরা যেভাবে চালাচ্ছেন, আমরাও সেভাবে চলছি। সরকারও আমাদের সহযোগিতা করছে না। একটি ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়ে কাজ শেষ সরকারের। এই সুযোগে বাস মালিকরা যাচ্ছেতাই করে বেড়াচ্ছে। আমি একটু কথা বলি দেখে পাঁচ থেকে সাত বছর ধরে ভাড়া নির্ধারণের টেবিলেও আমাকে রাখা হয় না। এখন যাত্রীরা ৬০ শতাংশ বেশি ভাড়া দিচ্ছেন। কিন্তু যাত্রীদের সুযোগ না দিয়ে পাশের সিটে আরেক যাত্রী তুলছেন। সরকার সঠিকভাবে তদারকি না করলে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে না। আর যদি সব যাত্রীই ফুঁসে উঠে রাস্তায় নামেন, তাহলে হয়তো পরিবর্তন হতে পারে। না হলে যাত্রীদের ভাড়া বেশি দেওয়া ছাড়া আর কোনো সুযোগ নেই।’
সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘যাত্রীরা ভাড়া বেশি দিচ্ছেন এবং বাসের হেলপার বেশি লোকজন তুলছেন। আমরা এসব ব্যাপার নিয়ে আজ বিআরটিএর সঙ্গে বৈঠক করেছি। বাস মালিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বসেছি। আজ পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গেও কথা হয়েছে। ট্রাফিক পুলিশ মাঠে নামবেন। একটা সমাধান দ্রুতই হবে বলে আশা করছি।’