বান্ধবীর সাক্ষ্য : ওসি ব্যবস্থা নিলে নুসরাতকে জীবন দিতে হতো না
ভিডিও ভাইরালের অভিযোগে সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে দায়ের করা ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মামলায় ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতের বান্ধবী নাসরিন সুলতানা ফূর্তি আদালতে সাক্ষ্য দেন।
ফূর্তি তাঁর সাক্ষ্যে বলেন, ‘গত ২৭ মার্চ নুসরাতের শ্লীলতাহানির অভিযোগে যে মামলা হয়েছিল তার জন্য আমাদের থানায় ডাকা হয়। আমার সামনে নুসরাতের ভিডিও ধারণ করা হয়। ভিডিও ধারণ করার সময় নুসরাতকে বার বার বলা হচ্ছিল মুখ থেকে হাত সরাতে। সেদিন নুসরাতকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আমাকেও (ফূতি) জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
‘এরপর ওসি মোয়াজ্জেম আমার মুখের নেকাব খুলতে বলেন। আমি জিজ্ঞেস করি, কেন নেকাব খুলতে হবে? ওসি বলে, নেকাব খুলে জোরে কথা বলতে হবে। যেন আমি শুনতে পাই। এরপর নিশাতকে (নুসরাতের আরেক বান্ধবী) ডেকে তারও ভিডিও রেকর্ড করে। পরে আমরা চলে আসি।’
ফূর্তি আরো বলেন, কিছুদিন পর নুসরাতের ভিডিও করার ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখতে পাই। ওসি মোয়াজ্জেম যদি সে সময় আইনগত ব্যবস্থা নিতেন তাহলে নুসরাতকে জীবন দিতে হতো না।
গত ২০ নভেম্বর ঢাকার সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের বিচারক আস-শামস জগলুল হোসেন এ রায়ের দিন নির্ধারণ করেন। তিনি এই আইনে প্রথম আসামি।
এই মামলায় ফূর্তির পর আদালতে নুসরাতের আরেক বান্ধবী নিশাত সুলতানা সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্যে তিনি বলেন, গত ২৭ মার্চ নুসরাতের শ্লীলতাহানির মামলার জন্য পুলিশ আমাদের মাদ্রাসায় এসে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। ওখানে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়। এরপর আমি, নুসরাত, ফূর্তি ও কলেজের প্রিন্সিপালকে থানায় নেওয়া হয়। ওসি মোয়াজ্জেম প্রিন্সিপালকে এক রুমে বসান। ওসি সাহেব আমাকে অন্য রুমে পাঠিয়ে দেন। অন্য রুমে বসা অবস্থায় পুলিশ এসে ১০/১৫ মিনিট পরে আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। ওই সময় ওসি মোয়াজ্জেম মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আমার কথা রেকর্ড করেন।
সাক্ষ্যে নিশাত আরো বলেন, ‘আমি ওসিকে জিজ্ঞাস করি, কেন ভিডিও রেকর্ড করা হচ্ছে? উত্তরে ওসি মোয়াজ্জেম জানান, মামলার স্বার্থে এটা করা হচ্ছে। অন্য রুমে নুসরাত ও ফূর্তি ছিল। থানা থেকে বের হয়ে ফূর্তিকে আমি জিজ্ঞেস করি, তোরও কি ভিডিও ধারণ করেছে? সে হ্যাঁ বলে। এর কিছু সময় পর আমরা তিনজন চলে আসি। ঘটনার কিছুদিন পর নুসরাতের ভিডিওটা ইউটিউবে দেখতে পাই। এসব নিয়ে অনেক মানববন্ধনও হয়েছে।’
এর আগে গত ১৭ জুন ওসি মোয়াজ্জেম জামিন আবেদন করলে নাকচ করেন সাইবার ট্রাইব্যুনাল। পরে তিনি ২ জুলাই হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন। সেখানে তাঁর জামিন নাকচ হয়।
গত ১৬ জুন শাহবাগ এলাকা থেকে মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২০ জুন সাইবার ট্রাইব্যুনালে ওসি মোয়াজ্জেমের পক্ষে কারাগারে ডিভিশন পাওয়ার বিষয়ে আবেদন করা হলে বিচারক গত ২৪ জুন তাঁকে প্রথম শ্রেণির বন্দির (ডিভিশন) সব সুবিধা দেওয়ার নির্দেশ দেন।
সোনাগাজী থানায় মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে ‘অসম্মানজনক’ কথা বলায় এবং তাঁর জবানবন্দির ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়াপর অভিযোগ এনে গত ১৫ এপ্রিল সাইবার ট্রাইব্যুনালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইয়্যেদুল হক সুমন বাদী হয়ে এ মামলা করেন।
বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায় করা অভিযোগটি পিটিশন মামলা হিসেবে গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল। সেইসঙ্গে মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তাকে তদন্ত করে ৩০ এপ্রিল প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
গত ২৭ মে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার রীমা সুলতানা আদালতে প্রতিবেদন জমা দেন। একই দিন মামলার তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে একই ট্রাইব্যুনালের বিচারক সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। একই সঙ্গে ১৭ জুন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য করেন।
পিবিআইর প্রতিবেদনে বাদীসহ ১৫ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এর মধ্যে সোনাগাজী থানার চারজন পুলিশ সদস্যও রয়েছেন।
প্রতিবেদনে পিবিআই বলেছে, ‘নুসরাত জাহান রাফির বয়স কম এবং তিনি একজন মাদ্রাসাছাত্রী। তাকে কয়েকজন পুরুষের সামনে শ্লীলতাহানির বক্তব্য শোনা এবং তা ভিডিওধারণ করা ন্যায়সংগত নয়। নারী ও শিশুরা যেহেতু শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় থানায় আসেন, সেহেতু নারী ও শিশুদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুলিশ সদস্যদের অনেক বেশি সহনশীল হওয়া প্রয়োজন।’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকেও নিয়মবহির্ভূতভাবে ভিকটিম নুসরাত জাহান রাফির বক্তব্যের ভিডিও ধারণ ও প্রচার করে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায় অপরাধ করেছেন।’
গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করেন ভুক্তভোগী নুসরাতের মা। পরে সিরাজ-উদ-দৌলাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
যৌন হয়রানির অভিযোগ করতে যাওয়ার পর সোনাগাজী থানার ওসির কক্ষে ফের হয়রানির শিকার হতে হয় নুসরাতকে। নিয়ম না মেনে জেরা করতে করতেই নুসরাতের বক্তব্য ভিডিও করেন ওসি। মৌখিক অভিযোগ নেওয়ার সময় দুজন পুরুষের কণ্ঠ শোনা গেলেও সেখানে নুসরাত ছাড়া অন্য কোনো নারী বা তাঁর আইনজীবী ছিলেন না।
গত ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষার আগমুহূর্তে মিথ্যা কথা বলে নুসরাতকে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে চাপ দেয় দুর্বৃত্তরা। মামলা তুলে নিতে অস্বীকৃতি জানালে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় তারা। ওই দিন নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতাল এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে গত ১০ এপ্রিল চিকিৎসাধীন নুসরাতের মৃত্যু হয়।
এদিকে গত ২৪ অক্টোবর নুসরাত হত্যা মামলায় ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার দায়ে মামলার প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ ১৬ আসামির সবার ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত।