বাউসী স্কুলের পুনর্মিলনী, ২৮ বছর পর কৈশোরে ফেরা

নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাউসী অর্দ্ধচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯৯২ সালে মাধ্যমিক (এসএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলনী উদযাপিত হয়েছে। গত ২০ ডিসেম্বর স্কুল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এই পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রাক্তনরা এসে অংশ নেন। দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠান প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মিলনমেলায় রূপ নেয়। গান, আবৃত্তি, গল্প, আড্ডা আর স্মৃতিচারণায় প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা হারিয়ে যান প্রায় তিন দশক আগে তাদের কৈশোরের আনন্দ-উচ্ছ্বল দিনগুলোতে।
বাউসী অর্দ্ধচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৯ সালে। বাবু রামসুন্দর সাহা এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। পিছিয়ে পড়া জনপদের এই স্কুলে জেলার অনেক খ্যাতিমান শিক্ষক শিক্ষকতা করেছেন। স্কুলের সুনামের কারণেই অনেক দূর-দূরান্ত থেকেও শিক্ষার্থীরা এসে এখানে পড়াশোনা করেছেন। সেসব কৃতী শিক্ষার্থী আজ দেশ-বিদেশে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
শুধু পড়াশোনায় নয়, খেলাধুলা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেও এই স্কুল ‘বাতিঘর’ হিসেবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে আজও আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। সময়ের প্রয়োজনে দুই দশক আগে স্কুলটিতে উচ্চ মাধ্যমিক (কলেজ) শাখাও চালু করা হয়েছে। বেড়েছে স্কুলটির ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা আর পরিধি।
সেই স্কুলের ১৯৯২ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের দিনব্যাপী পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের প্রথম অধিবেশন শুরু হয় শীতের সকালের মিষ্টি রোদের আবাহনে। কোরআন তিলওয়াত ও গীতপাঠের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের শুরু হয়। কোরআন তিলওয়াত করেন স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র আব্দুল আমীন, গীতা পাঠ করেন অনন্যা সাহা। এরপর স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক, যারা লোকান্তরিত হয়েছেন তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
এরপর স্কুলের প্রাক্তন ও বর্তমান মিলিয়ে আটজন শিক্ষককে সম্মাননা প্রদান করা হয় ৯২ ব্যাচের পক্ষ থেকে। এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন বাউসী অর্দ্ধচন্দ্র উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মো. তাহেরুল ইসলাম। এ সময় অধ্যক্ষের হাতে স্কুলকে একটি সম্মাননা ক্রেস্ট উপহার দেওয়া হয়।

সম্মাননাপ্রাপ্ত শিক্ষকরা হলেন- স্কুলের প্রাক্তন সহকারী প্রধান শিক্ষক আবদুল মালেক, ইংরেজির শিক্ষক নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা, জীববিজ্ঞানের শিক্ষক সুজিত চন্দ্র সরকার, গণিত শিক্ষক আনোয়ারুল ইসলাম ও মো. ফারুক আহমদ, স্কুলের বর্তমান সহকারী প্রধান শিক্ষক আব্দুল মোমেন বিশ্বাস ও শরীরচর্চা শিক্ষক আব্দুল ফাত্তাহ। ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়ার পাশাপাশি সব শিক্ষককে উপহার হিসেবে শাল প্রদান করা হয়। এ ছাড়া শুভেচ্ছা স্মারকও উপহার দেওয়া হয়।
এ সময় সেখানে কলেজ শাখা পরিচালনা কমিটির সদস্যরা ছাড়াও স্কুলের অন্য শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন। তাদেরও স্মারক উপহার দেওয়া হয়। স্মারক উপহার দেওয়া হয় প্রাক্তনদের পরিবারের সদস্যদেরও।
প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রথমবারের মতো সম্মাননা ও ভালোবাসা পেয়ে অনেক শিক্ষক আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তাঁরা তাঁদের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, একজন শিক্ষক তাঁর ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে এইটুকু সম্মাননাই শুধু আশা করে। যে শ্রদ্ধা আর ভারোবাসা তোমরা আমাদের দিয়েছ, তাতে মনে হচ্ছে আমাদের শিক্ষকতার জীবন আজ পূর্ণ হয়েছে। এই গ্রামীণ জনপদে এই ধরনের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান সত্যিকার অর্থেই একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। গ্রামের সঙ্গে, স্কুলের সঙ্গে দূর-দূরান্তে থাকা মানুষের যোগাযোগ, নাড়ীর টানকে আরো শক্ত করবে এই আয়োজন। শিক্ষাগুরুরা তাদের শিক্ষার্থীদের সুন্দর ও মঙ্গলময় জীবন কামনা করেন।
অপরদিকে সম্মাননাপ্রাপ্ত শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বক্তব্য দেন ১৯৯২ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ফেসবুক ক্লোজ গ্রুপ ও পেজের অন্যতম অ্যাডমিন সুপ্রিয় পণ্ডিত। তিনি বলেন, এই শিক্ষককরা আমাদের যে শিক্ষা দিয়েছেন তাই নিয়েই আমরা জীবনের পথে চলছি। তাদের নীতি-নৈতিকতার শিক্ষাই আজ আমাদের জীবনের পাথেয়। আমাদের জীবন সেই অর্থে এই শিক্ষকদেরই দান। তাদের সম্মানিত করার সামর্থ-সাধ্য আমাদের নেই। তাদের সম্মানিত করে আমরা নিজেরাই সম্মানিত ও গৌরবান্বিত বোধ করছি।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যক্ষ তাহেরুল ইসলাম বলেন, আমি নিজেও এই স্কুলের ছাত্র। ৯২ ব্যাচ প্রথমবারের মতো এই স্কুলে পুনর্মিলনী করে সবার জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। আশা করি, আগামী দিনে এভাবে আরো অনেক ব্যাচ এগিয়ে আসবে। এ ধরনের অনুষ্ঠানের জন্য সবার জন্য সবসময় আমাদের পক্ষ থেকে স্কুলের দরজা খোলা থাকবে। আমি নিজেও অনেক ব্যাচ নিয়ে এই ধরনের একটি পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের স্বপ্ন দেখি। কিন্তু নানা বাস্তবতায় সেটি আজও বাস্তবায়ন করে উঠতে পারিনি। এজন্য আমরা তোমাদের সহযোগিতা চাই।
বিকেল ৩টা থেকে শুরু হয় দ্বিতীয় অধিবেশন। এখানে শুধু ব্যাচের শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের সদস্যরাই অংশ নেন। এ সময় সবাই নিজেদের মতো করে স্মৃতিচারণা, আড্ডা আর ছবি তোলায় মেতে উঠেন। কবিতা আবৃত্তি করেন ফেরদৌসী বেগম, জাদু দেখান জাহাঙ্গীর আলম, স্মৃতিচারণা করেন স্বপ্না রায়, শেখ মো. শরিফুল আলম, আলহাজ আবুল হাসেম, আবু রাহেল, সিদ্দিকুর রহমান, আবদুল মোতালেব প্রমুখ। বিদেশ থেকেও অনেক প্রাক্তন বার্তা পাঠিয়ে আয়োজনের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন এবং মঙ্গল কামনা করেন।

এ সময় প্রাক্তনরা বলেন, এক বছর আগে একটি গ্রুপের মাধ্যমে তাঁরা সংগঠিত হওয়া শুরু করেন। শুরু থেকেই সবার আকাঙ্ক্ষা ছিল একত্রিত হওয়ার, হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার। গ্রুপে সদস্য সংখ্যা দিন দিন বেড়েছে। এর মাধ্যমের সবাই সবার সুখ-দুঃখের ভাগিদার হচ্ছে। এই প্রচেষ্টার আন্তরিক রূপ হচ্ছে এই পুনর্মিলনী। ভবিষ্যতেও এই ধরনের প্রচেষ্ঠা অব্যাহত থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রাক্তনরা।
সবশেষে প্রাক্তনরা অভিমত ব্যক্ত করেন, এই স্কুল ও এলাকার প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯২ সালের ব্যাচের শিক্ষার্থীরা আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ফাউন্ডেশন গঠনের কার্যক্রম শুরু করার ব্যাপারে একমত হন। সেই ফাউন্ডেশনের জন্য ব্যাচের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে অর্থও বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই ফাউন্ডেশন স্কুলের গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৃত্তি এবং নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ফাউন্ডেশনের আইনগত প্রক্রিয়া ও নীতি-নির্ধারণীমূলক বিষয়াদি সম্পন্ন করা হবে।