বছর পেরোলেও চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন আসেনি
রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের বছর পার হয়ে গেলেও এখনো আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেনি পুলিশ। এ পর্যন্ত এ মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নয়টি তারিখ নিয়েছে পুলিশ। আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ফের দিন রয়েছে।
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে চুড়িহাট্টায় একটি ভবন থেকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘হাজি ওয়াহেদ ম্যানশন’ নামের একটি পাঁচতলা ভবনের নিচতলা থেকে এই অগ্নিকাণ্ডের সূচনা হয়। এ ঘটনার পর নিহত ব্যক্তিদের মরদেহ ও আহতদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়। তখন সেখানে স্বজনদের কান্না-আহাজারিতে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
ভবনটি নিচতলায় ছিল কেমিক্যালের গুদাম ও প্লাস্টিকের তৈজসপত্র তৈরির উপকরণের (দানা প্লাস্টিক) চারটি দোকান। আগুন দ্রুতই ভবনটির পাশের আনাস হোটেল, রাজ হোটেলসহ উল্টো পাশের চারটি ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে একটি কমিউনিটি সেন্টারও ছিল। হাজি ওয়াহেদ ম্যানশনের ভেতর থেকেই অনেক মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। দুর্ঘটনায় ভবনের সামনে থাকা দুটি প্রাইভেটকার, দুটি পিকআপভ্যান, ছয়টি মোটরসাইকেল ও ৩০টি রিকশা পুড়ে যায় বলে তখন প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনাতে উঠে এসেছিল।
এ ঘটনার পর ১৩টি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের ৩৭টি ইউনিট প্রায় পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। এতে বিমান বাহিনীর দুটো হেলিকপ্টারও ব্যবহার করা হয়। সরু রাস্তা হওয়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের বেশ বেগ পেতে হয়।
এ ঘটনার পর স্থানীয় বাসিন্দা মো. আসিফ বাদী হয়ে রাজধানীর চকবাজার থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে মো. হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদের নাম এজাহারে উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১০ থেকে ১২ জনকে আসামি করা হয়। মামলা দায়েরের পর পরই আসামি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে নেন। পরবর্তী সময়ে গত বছরের ২ এপ্রিল ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কায়সারুল ইসলামের আদালতে জামিনের আবেদন করা হলে বিচারক তাঁদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কারাগারে পাঠানোর পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মোরাদুল ইসলাম আসামিদের হাজির করে ১০ দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করলে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরী তাঁদের সাত দিন রিমান্ডের আদেশ মঞ্জুর করেন। রিমান্ড শেষে তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়। পরে অবশ্য তাঁরা জামিনে মুক্তি পান।
এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চকবাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কবির হোসেন হাওলাদার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের এই ঘটনায় প্রথমে একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করা হয়। পরে হাজি ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক দুই ভাইয়ের নামে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। তাঁরা দুজনই এখন জামিনে আছেন। মামলার তদন্ত প্রতিবেদন এখনো জমা দিতে পারিনি আমরা। তবে দ্রুতই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেব আমরা।’
কবির হোসেন আরো বলেন, ‘তবে এখনো পর্যন্ত আমাদের যে ফাইন্ডিং আছে, তাতে জানা গেছে, প্রথমে গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। তারপর রাসায়নিকের গুদামে আগুন লাগে। সেখান থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।’
যেভাবে চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ড
তখন রাত প্রায় সাড়ে ১০টা। চুড়িহাট্টার নন্দকুমার পাঁচমুখী মোড়ে তখনো তীব্র যানজট। ঘিঞ্জি রাস্তায় আটকে ছিল প্রাইভেটকার, পিকআপ, রিকশা, ঠেলাগাড়ি, মোটরসাইকেলসহ শতাধিক যানবাহন। ঠিক এ সময়েই বিকট এক শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকাটি। ভয়ে মানুষ যে যেভাবে পারে দৌড়ানো শুরু করে। আহতদের মধ্যে যাদের সেই সক্ষমতা ছিল না, তারা রাস্তার মধ্যেই এদিক-সেদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে।
এ ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ফায়ার সার্ভিসের কমিটি করা হয় তিন সদস্যের আর শিল্প মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির সদস্য ছিলেন ১২ জন। এর বাইরে চকবাজার থানায় একাধিক মামলাও হয়।
সে সময় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার ছিলেন আছাদুজ্জামান মিয়া। তিনি ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটনাস্থলে গিয়ে গণমাধ্যমের কাছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘গাড়ির সিলিন্ডার প্রথমে বিস্ফোরিত হয়। তারপর বাঁ পাশে থাকা এসির ট্রান্সফরমারে সেটি হিট করে। সেখান থেকে হিট হয় ট্রান্সফরমারে। এ আগুনটা ছড়িয়ে পড়ে গাড়িতে। পাশের একটি পিকআপে অনেক গ্যাসের সিলিন্ডার নেওয়া হচ্ছিল। পুরো সিলিন্ডারগুলো একচোটে বিস্ফোরিত হয়ে
পাশের হোটেলে আগুন লাগে। হোটেলে চারটা বড় বড় রান্নার সিলিন্ডার ছিল। ওই চারটা সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়ে আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।