পাপিয়ার দায় নিচ্ছে না কেউ!
চলমান শুদ্ধি অভিযানের মধ্যে হঠাৎ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হতে আটক হন আলোচিত নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ। গ্রেপ্তারের পরই কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়।
এখন ঢাকায় যেমন কেউ তার দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন না, ঠিক তেমনি নরসিংদীতে যাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে তার বাড়বাড়ন্ত, তাঁরাও কেউ দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন না।
২০১৪ সালে যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নাজমা আকতার ও সাধারণ সম্পাদক অপু উকিলের উপস্থিতিতে নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সম্মেলন হয়। সম্মেলন নরসিংদী শহরে হলেও কমিটি দেওয়া হয় ঢাকা থেকে।
এই কমিটির বিষয়ে যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নাজমা আকতার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, “জেলা কমিটিতে পাপিয়া আগে কোনো পদে না থাকলেও তাঁকে পদ দিতে অনেকটা ‘বাধ্য’ হয়েছি। সম্মেলনের পরে স্থানীয় অনেকে পাপিয়ার বিরোধিতা করলেও ক্ষুদ্র একটি অংশ তাঁর পক্ষে ছিল। তাই আমরা সেখানে কমিটি দিতে পারিনি। পরে ঢাকায় এসে আমি ও আমার সাধারণ সম্পাদক মিলে কমিটি দেই। সেখানে আমার পছন্দের ছিল সভাপতি আর অপুর পছন্দের ছিল পাপিয়া।’’
নাজমা আকতার আরো বলেন, ‘অপু পক্ষে ছিল ঠিক; কিন্তু তিনি কখনই পাপিয়ার এসব অপকর্মের কথা জানত বলে আমার মনে হয় না। ইন্টার পাস একটা মেয়ে হঠাৎ করে সম্রাজ্ঞী হয়ে ওঠেছে নিশ্চয় তার পিছনে কারো হাত রয়েছে। তারা কারা আমরা তাদের সামনে আনতে চাই। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও আমরা এ বিষয়ে কথা বলেছি।’
কাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে পাপিয়া এতদূর এগিয়েছে জানতে চাইলে নাজমা আক্তার বলেন, ‘পাপিয়া কাদের সঙ্গে উঠাবসা করে তাদের খোঁজ করলেই সব পেয়ে যাবেন। র্যাব-পুলিশ তদন্ত করছে, সব বের হয়ে যাবে। আমাদের অনেকের সঙ্গে পাপিয়ার ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল, তাদের বের করুন।’
পাপিয়াকে অর্থের বিনিময়ে পদ দেওয়া হয়েছিল- এমন অভিযোগের বিষয়ে নাজমা বলেন, ‘পদবাণিজ্য করে যারা পাপিয়াকে পদ দিয়েছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা হোক। এমন মেয়েদের জন্য যুব মহিলা লীগের সম্মান যায়।’
তবে এই ব্যাপারে জানতে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে অপু উকিলের সঙ্গে এনটিভি অনলাইনের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি পাপিয়ার ব্যাপারে কোনো কিছু বলতে চাই না। আমি এখন মিটিংয়ে আছি।’
এ সময় অপু উকিল আরো জানান, বিষয়টি নিয়ে তিনি ও সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, নারীদের নিয়ে অনৈতিক কর্মকাণ্ড, জাল নোট সরবরাহ, রাজস্ব ফাঁকি, অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে গত শনিবার যুব মহিলা লীগের নরসিংদী শাখার সাধারণ সম্পাদক শামিমা নূর পাপিয়া গ্রেপ্তার হন।
রাজধানীর গুলশানে একটি অভিজাত হোটেলের প্রেসিডেন্ট স্যুট নিজের নামে কয়েক মাস ধরে বুক করে অবৈধ নারী, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা এবং চাঁদাবাজিসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছিলেন শামিমা নূর পাপিয়া। র্যাব বলছে, গত তিন মাসে শুধু ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলেই পাপিয়া বিল দিয়েছেন এক কোটি ৩০ লাখ টাকা। হোটেলটির বারে তিনি প্রতিদিন বিল দিতেন প্রায় আড়াই লাখ টাকা।
পাপিয়ার বিষয়টি এমন এক সময়ে সামনে এলো যখন আওয়ামী লীগ তাঁর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর বিতর্কিত নেতাদের বিরুদ্ধে এক ধরনের শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছে। এই অভিযানের অংশ হিসেবে অনেক পরিচিত ও প্রভাবশালী নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সরকার ও আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এই অভিযান অব্যাহত রাখার কথা বলা হয়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে শামীমা নূর পাপিয়াদের দলে দরকার নেই বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান। গতকাল বুধবার এনটিভি অনলাইনকে এই নেতা বলেন, ‘দল থেকে পাপিয়াদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হবে।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা একটি বড় দল- এই দলে ভালো, খারাপ সবই আছে। সব আমরা ভালো লোক, এই দাবি আমি করি না। তবে খারাপ লোকদের চিহ্নিত করে, খারাপকে তার অপকর্মের জন্য শাস্তি দেওয়ার বিধান এই দলে আছে।’
যুব মহিলা লীগ নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘সংগঠনটির সম্মেলনের সময় চলে এসেছে। মার্চে তাদের মেয়াদ শেষ হবে। তাদের সম্মেলন এমনিতেই করতে হবে।’
২০১৭ সালের ১১ মার্চ যুব মহিলা লীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে নাজমা আক্তারকে সভাপতি এবং অধ্যাপিকা অপু উকিলকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এর তিন মাস পর ২৫ জুলাই যুব মহিলা লীগের ১২১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়।
কে এই পাপিয়া
নরসিংদী জেলা শহরের ভাগদী মারকাজ মসজিদ এলাকার বাসিন্দা পেট্রোবাংলার অবসরপ্রাপ্ত গাড়িচালক সাইফুল বারীর মেয়ে পাপিয়া। ২০০৯ সালে নরসিংদী সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি, এরপর ২০১২ সালে স্নাতকে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে স্নাতক শেষ করতে পারেননি তিনি।
পাপিয়ার ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা নিয়ে নানা ধরনের কথা শোনা যায় সেই সময়ের ছাত্রনেতাদের কাছে। কারো বক্তব্য, পাপিয়া ছাত্র রাজনীতিতে কখনোই সক্রিয় ছিলেন না। আবার কারো বক্তব্য, কলেজ জীবন থেকেই পাপিয়া উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত।
যুব মহিলা লীগে পদ পাওয়ার আগেই পাপিয়া বিয়ে করেন নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমনকে। তিনিও এখন কারাগারে আছেন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ
যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আকতার এবং সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক অপু উকিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে সাক্ষাৎ করেছেন। গতকাল বুধবার দুপুরে তাঁরা গণভবনে যান। সাক্ষাৎকালে প্রধানমন্ত্রী যুব মহিলা লীগের বির্তকিত কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে তাদের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারে অপু উকিল এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাদের বলেছেন, সারা দেশের আমাদের যতগুলো ইউনিট আছে সেখানে যদি কোনো বিতর্কিত ব্যক্তি থাকে তাহলে তাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে।
“প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই শহরে এবং শহরের বাইরে কে কী করে, কীভাবে জীবন চালায় সব তাঁর জানা। কেউ আদর্শের জন্য লড়াই করছে আর কেউ আদর্শ বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করছে। বিপথগামীদের আমরা ছাড়ব না, এদের সঙ্গে আমার কোনো আপস নেই’”, যোগ করেন অপু উকিল।