নেগেটিভ সত্ত্বেও কোভিড আইসিইউতে, পুলিশের হস্তক্ষেপে কমল বিল
রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের শাহাজাহান খান হাপানির সমস্যা নিয়ে ধানমণ্ডিতে অবস্থিত পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। এরপর তাঁর নমুনা সংগ্রহ করে করোনাভাইরাসজনিত কোভিড-১৯ রোগের পরীক্ষা করা হলে ফলাফল ‘নেগেটিভ’ আসে।
করোনা নেগেটিভ আসার পরও ‘শাহাজাহানের শ্বাসকষ্ট ছিল’ কারণ দেখিয়ে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয় তাঁকে। ওইদিনই শাহাজাহানের সিটিস্ক্যান ও এক্সরে করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তখনও তাঁর শ্বাসকষ্ট ছিল বলে দাবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।
সিটিস্ক্যান ও এক্সরে পরীক্ষার রিপোর্ট আসার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শাহাজাহানের পরিবারকে জানিয়ে দেয়, ‘সিটিস্ক্যানে দেখা গেছে শাহাজাহান করোনায় আক্রান্ত’। এরপর তাঁকে সাধারণ আইসিইউ থেকে নেওয়া হয় হাসপাতালের কোভিড আইসিইউতে। একই দিনে রাজধানীর ইউনিভার্সেল কার্ডিয়াক হাসপাতালে শাহাজাহানের বৃদ্ধা মাকেও ভর্তি করা হয় শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার কারণে। ঘটনাটি গত ১৭ জুলাইয়ের।
পপুলারের কোভিড ইউনিটের আইসিইউতে রেখে শাহাজাহান খানকে চিকিৎসা দেওয়ার মধ্যে গত ২০ জুলাই সকালে তিনি মারা যান। এরপর চিকিৎসা বাবদ খরচ হওয়া অর্থ নিয়ে বাধে বিপত্তি।
নিহতের পরিবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানান, ভর্তির সময় জমা দেওয়া ৫৫ হাজার টাকা ছাড়া আর কোনো টাকা দিতে পারবে না তারা। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয়, চিকিৎসা বাবদ খরচ দুই লাখ ৩১ হাজার টাকা শোধ না করলে লাশ দেবে না তারা।
এরপরই শাহাজাহান খানের ক্ষুব্ধ ভাতিজা আহসান হাবিব ২০ জুলাই সকালে পুলিশের জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করেন। ৯৯৯ থেকে বিষয়টি ধানমণ্ডি থানায় জানানো হয়। পরে ধানমণ্ডি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শিহাব তন্ময় আহসান হাবিবের সঙ্গে যোগাযোগ করে পপুলার হাসপাতালে যান। তারপর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে দুই লাখ ৩১ হাজার টাকার বিষয়টি ৭৫ হাজার টাকায় সমাধান করেন। পরে ভুক্তভোগীরা লাশ নিয়ে কামরাঙ্গীচরের নিজ বাসায় চলে যায়।
পুরো ঘটনাটি এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন নিহতের ভাতিজা আহসান হাবিব, উপপরিদর্শক (এসআই) শিহাব তন্ময় ও পপুলার হাসপাতালের পরিচালক ডা. ইশতিয়াক।
আহসান হাবিব অভিযোগ করে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমার চাচার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল বলে পপুলার হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে নেওয়ার পর আমরা করোনা টেস্ট করাই। রিপোর্ট আসে নেগেটিভ। তারপর চাচাকে (শাহাজাহান) সাধারণ আইসিইউতে নেওয়া হয়। পরে সিটিস্ক্যান ও এক্সরে করে হাসপাতাল। করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট আসার এক-দুই ঘণ্টার ভেতরে চিকিৎসক জানালেন, আমার চাচা করোনায় আক্রান্ত। তারপর কোভিড ইউনিটের আইসিইউতে নেওয়া হয় তাঁকে। সেখানে তিনদিন রাখা হয়। ২০ জুলাই হাসপাতাল ঘোষণা করে যে, আমার চাচা মারা গেছেন। আমার প্রশ্ন হলো, কোভিড-১৯ নেগেটিভ হওয়ার পরও কেন তাঁকে করোনা ইউনিটে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হলো? এর আগেও আমরা দুইবার চাচার করোনা টেস্ট করিয়েছিলাম, সেখানেও নেগেটিভ আসে। আইসিইউতে থাকার সময় চাচা সম্পর্কে আমরা নিয়মিত আপডেটও পাচ্ছিলাম না। পরে দেখলাম বিল আসে দুই লাখ ৩১ হাজার টাকা। আমরা ওই টাকা আর দিতে চাইনি হাসপাতালকে।’
আহসান হাবিব আরো বলেন, ‘টাকা দিতে না চাওয়ায় হাসপাতাল আমাদেরকে লাশ দিতে চায়নি। পরে বাধ্য হয়ে আমি ৯৯৯ নম্বরে কল করি। কিছুক্ষণ পর ধানমণ্ডি থানা থেকে পুলিশ আসে। আসার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নরম হয়ে যায়। ম্যাজিস্ট্রেট ডাকার হুমকি দেওয়া হলে একপর্যায়ে অগ্রিম জমা দেওয়া ৫৫ হাজার টাকাসহ মোট ৭৫ হাজার টাকায় বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়। যদিও আমাদের আর একটি টাকাও দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু চাচার লাশ নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল। নতুবা মামলাও করতাম হাসপাতালের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে দাদির অবস্থাও ভালো ছিল না। আমার চাচা ও দাদিকে একই দিনে দুটি হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম। আজ (শুক্রবার) আমার দাদিও ইউনিভার্সেল কার্ডিয়াক হাসপাতালের আইসিইউতে মারা গেছেন। এখন আমরা তাঁর লাশ নিয়ে বাড়িতে যাচ্ছি।’
৯৯৯ থেকে ধানমণ্ডি থানায় জানানো হলে এসআই শিহাব তন্ময় হাসপাতালে গিয়ে বিষয়টির সমাধান করেন। শিহাব তন্ময় এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘খবর পেয়ে আমি হাসপাতালে যাই। গিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দফায় দফায় বসে বিষয়টির সমাধান করি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের যুক্তি করোনার টেস্টে নেগেটিভ এলেও ফুসফুসের সিমটম দেখে বোঝা যায় শাহাজাহানের করোনা পজিটিভ। এবং ফুসফুসের অবস্থা দেখে শাহাজাহানকে কোভিড আইউসিইউতে নেওয়া হয়। কথা বলার সময় আমি একা আর তাঁরা ১০ জন চিকিৎসক ছিলেন। একটা পর্যায়ে আমি তাদেরকে বললাম, মেডিকেল টার্মের ব্যাপারে আমি ভালো বুঝব না। তার চেয়ে ভালো ম্যাজিস্ট্রেট ডেকে সমাধান করা। এরপর আরো নানা ধরনের কথা হয়, বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে মোট ৭৫ হাজার টাকায় বিষয়টি সমাধান হয়। আমি আহসান হাবিবকেও বলেছিলাম মামলা করতে। কিন্তু মামলা করলে লাশ নিয়ে ঝামেলা হতে পারে এই ভয়ে তিনি মামলাও করতে চাননি।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পপুলার হাসপাতালের পরিচালক ডা. ইশতিয়াক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘প্রথমে শাহাজাহানকে কিন্তু নরমাল আইসিইউতে রাখা হয়। তারপর আমরা তাঁর সিটিস্ক্যান করি। সিটিস্ক্যান করে আমাদের মনে হয়েছে তিনি ক্লিনিক্যাল করোনা রোগী বা সাসপেকটেড রোগী। এরপর তাঁকে কোভিড আইসিইউতে নেওয়া হয়। করোনা রিপোর্টে নেগেটিভ আসতে পারেই। কারণ, করোনা রিপোর্ট কিন্তু ভুল আসার সম্ভাবনাও থাকে বলে সবাই জানে। এমন অনেক রোগী আছেন যাদের করোনা টেস্টে ফলাফল নেগেটিভ এসেছে কিন্তু বাস্তবে তারা করোনা পজিটিভ। ওই রোগীর নিউমোনিয়াও ছিল। প্রচুর শ্বাসকষ্ট ছিল। পরে ঝামেলা বাধল টাকা পরিশোধ করা নিয়ে। কিন্তু ওই রোগীর পেছনে তো আমাদের অনেক খরচ হয়েছে; সেই টাকা কে দেবে? তারপর পুলিশ এসে আমাদের সঙ্গে কথা বলে। আমরা মানবিক বিবেচনায় মাত্র ৭৫ হাজার টাকার বিনিময়ে বিষয়টি সমাধান করি। পুলিশের সামনেই কিন্তু নিহতের পরিবারের লোকজন বলেছিল, এই ব্যাপারে তাঁদের আর কোনো অভিযোগ নেই এবং তাঁরা সন্তুষ্ট।’