নিরাপত্তাকর্মীকে ঘুষি মেরে হলি আর্টিজানে ঢুকে পড়ে জঙ্গিরা
‘২০১৬ সালের ১ জুলাই। রমজান মাস। প্রতিদিনের মতো সবাই খাওয়া-দাওয়া করছেন রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয়। ব্যস্ত সময় পার করছেন রেস্তোরাঁর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দেশি-বিদেশি ক্রেতায় ঠাসা রেস্তোরাঁ। কেউ বসে আয়েশ করে কফি খাচ্ছেন, কেউবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। হঠাৎ এলাপাতাড়ি গুলি, বোমার শব্দ। কিছু বুঝে উঠার আগেই রক্তাক্ত হয়ে উঠে রেস্তোরাঁ।’
আলোচিত এ মামলার অভিযোগপত্রে এভাবে উঠে আসে ভয়ঙ্কর সেই হত্যাযজ্ঞের বিবরণ।
কী ঘটেছিল সেই রাতে
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, পাঁচ জঙ্গি দুটি দলে বিভক্ত হয়ে বসুন্ধরার বাসা থেকে হলি আর্টিজানের পথে রওনা হন। ২০১৬ সালের ১ জুলাই বিকেল আনুমানিক ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার দিকে অস্ত্র-গুলি, গ্রেনেড, চাকু নিয়ে বের হন তাঁরা। রাত ৮টা ৪২ মিনিটে প্রথমে নিবরাস ইসলাম ও মীর সামেহ মোবাশ্বের, এরপর রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল, শফিকুল ইসলাম বাধন কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ৭৯ নম্বর রোড ধরে হলি আর্টিজানের মেইন গেটে যান।
মূল গেটের নিরাপত্তারক্ষী নূর ইসলাম তাদের পরিচয় ও কোথায় যাবেন জিজ্ঞাসা করলে নিবরাস নূর ইসলামের ডান চোখের নিচে ঘুষি মেরে হলি আর্টিজানের ভেতরে ঢুকে যান। সেখানে ঢুকেই গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে আতঙ্ক তৈরি করে জঙ্গিরা।
পুলিশের দাখিল করা অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, হামলার পরিকল্পনা গৃহীত হয় কয়েক স্তরে। জঙ্গিরা মাত্র ২০ মিনিটে গুলি করে এবং গলাকেটে একে একে হত্যা করে ২২ জনকে। একজনের সামনে অন্য একজনকে নির্মমভাবে হত্যার পৈশাচিক নৃশংসতায় মেতে ওঠেন জঙ্গিরা। তাঁরা এতটাই নিষ্ঠুর ছিলেন যে, লাশের সারি মেঝেতে রেখেই খাবার খান। হত্যাকাণ্ডের ছবি তুলে অ্যাপসের মাধ্যমে শীর্ষ নেতাদের কাছে পাঠান।
অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, ২০ মিনিটের মধ্যে পাঁচ জঙ্গি বিভিন্ন রুম, টয়লেট, চিলারঘর, হিমঘর প্রভৃতি স্থান থেকে লোকজনকে বের করে এনে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালান। তাঁরা দেশি-বিদেশি লোকজনকে গুলি করেন এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে/গলাকেটে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। হত্যার পর ছবি তুলে অ্যাপসের মাধ্যমে বাইরে অবস্থানরত তামিম চৌধুরী ও মারজানের কাছে পাঠান।
ঘটনার পর নব্য জেএমবির সব সদস্য বাসা পরিবর্তন করে নতুন বাসায় ওঠেন এবং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে আত্মগোপনে চলে যান। তামিম চৌধুরী নারায়ণগঞ্জ, তানভীর কাদেরী লালবাগ, বাশারুজ্জামান চকলেট ও ছোট মিজান চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থানার চককীর্তি ত্রিমোহনী এলাকায়, মেজর (অব.) জাহিদ রাজধানীর রূপনগর থানার রূপনগর আবাসিক এলাকায় অবস্থান করেন।
এরপর তাঁরা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, শোলাকিয়ার ঈদ জামাতে হামলাসহ সারা দেশে আরো হামলা এবং পুলিশ কর্মকর্তা যারা সরকারি কম্পাউণ্ডের বাইরে থাকেন তাদের খুঁজে বের করে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন।
এমন ঘটনা কল্পনাতেও ছিল না
অভিযোগপত্রে বলা হয়, এমন ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম। এমন একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দেশে ঘটবে তা হয়তো কারো কল্পনাতেও ছিল না। ঘটনা ঘটার পরে পুরো দেশে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। দেশের সব নাগরিকের চোখ ছিল গণমাধ্যমে। কী হতে যাচ্ছে ? কারাই বা এই ঘটনা ঘটিয়েছে? সব জল্পনা-কল্পনা ছাপিয়ে সকালেই সেনা কমান্ডোদের অভিযানে নিহত হন পাঁচ হামলাকারী। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরেকজনের মৃত্যু হয়। নিহত জঙ্গিদের ছবি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
এ ঘটনার পর সন্দেহভাজন গ্রেপ্তার হাসনাত করিম ও তাহমিদ হাসিব খানকে গ্রেপ্তার করা হয়।
হাসনাত করিম তখন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ও তাহমিদ হাসিব খান কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পরবর্তী সময়ে তাহমিদ হাসিব খানের বিরুদ্ধে পুলিশ হলি আর্টিজানের মামলায় সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় অব্যাহতি দিয়ে পুলিশকে সহযোগিতা না করার অভিযোগ এনে অপর একটি মামলা করেন। সেই মামলায় অবশ্য তাহমিদ হাসিব খানকে খালাস দেন ঢাকার সিএমএম আদালত। এরপর হলি আর্টিজানের মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়ার সময় সেখান থেকে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হাসনাত করিমকে অব্যাহতি দেয় পুলিশ। পরে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ হাসনাত করিমকে অব্যাহতি দেওয়ার নির্দেশ দেন।