নারায়ণের পরিবার গ্রামে ফিরল, তবে মেয়ের লাশ নিয়ে
বখাটের ভয়ে একাধিকবার বাসাও পাল্টেছিলেন নারায়ণ রায়ের পরিবার। শেষ পর্যন্ত কোনো উপায় না পেয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এই নিষ্ঠুর শহরে আর নয়। মেয়ে নীলা রায়ের জীবন রক্ষার্থে গ্রামেই থিতু হবেন। মেয়েটিও বাবার সঙ্গে গ্রামে ফিরল, তবে জীবিত নয়; লাশ হয়ে।
পরিবারের অভিযোগ, স্থানীয় বখাটে মিজানুর রহমান উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে নীলা রায়কে হত্যা করেছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুর রহমানের ছেলে মিজান একটি কলেজের শিক্ষার্থী।
পুলিশ জানায়, গত ২০ সেপ্টেম্বর রাতে বড় ভাই অলক রায়ের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ভাইকে নিয়ে রিকশায় এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের যাওয়ার জন্য বের হয় স্কুলছাত্রী নীলা রায়। পথে গতিরোধ করে বখাটে মিজানুর রহমান। বড় ভাইয়ের সামনে থেকে জোর করে নীলাকে তুলে নিয়ে পরিত্যক্ত একটি বাড়িতে যায়। সেখানেই উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে পালিয়ে যায় মিজানুর। রক্তাক্ত অবস্থায় স্থানীয়রা নীলাকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ব্যাপারে সাভার মডেল থানায় মামলা করা হলেও এখনো আসামিদের কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার জানান, আসামিদের গ্রেপ্তারে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। পুলিশ ও ডিবির বিভিন্ন ইউনিট মাঠে নেমেছে। আশা করি, ভালো একটি খবর শিগগিরই দিতে পারব।
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, আসামিরা গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে। তারা নিজেদের মোবাইল ডিভাইসগুলো থেকে দূরত্ব বজার রাখায় অবস্থান শনাক্ত করতে বেগ পেতে হচ্ছে। আসামিদের অবস্থান শনাক্ত করতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এবং র্যাব নিজেদের মতো করে কাজ করছে।
এদিকে, গতকাল সোমবার যখন নীলার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে, তখন তার বাড়িতে চলছে স্বজনদের আহাজারি।
ঘরজুড়ে মেয়ের অনেক স্মৃতি। পড়ার টেবিলের বই নেড়েচেড়ে আদরের একমাত্র কন্যার স্মৃতি হাতড়ে ফিরছিলেন মা মুক্তা রানি রায়।
মেয়ের বইখাতা বুকে জড়িয়ে বিলাপ করতে করতে নীলার মা মুক্তা রানি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই মিজান আমার মেয়ের পিছু নিয়েছিল। আমি বুঝিয়েছি, বাবা তুমি বড়লোকের ছেলে। আমরা গরিব। ভাড়া থাকি। তার ওপর আমরা হিন্দু। কিছুতেই কিছু শোনেনি। একপর্যায়ে আমরা মিজানের মা-বাবাকে জানিয়েছি। হুমকি দিয়ে বলত, থানায় জানালে, আমার স্বামী ও ছেলের লাশ ফেলবে। ভয়ে মুখ বুজে থাকতাম। আমাদের কষ্টে কেউ এগিয়ে আসেনি। আমার মেয়েটাকে মেরেই ছাড়ল।’
নীলার বাবা নারায়ণ রায় মেট্রোরেল প্রকল্পের সামান্য বেতনের কর্মচারী। শেষকৃত্যের জন্য মেয়েকে নিয়ে যখন শ্মশানের দিকে যাচ্ছিলেন নারায়ণ রায়, তখনো তার দুচোখ ঝাঁপসা।
‘আমি তো মেয়ের জন্যই গ্রামে ফিরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ফিরলাম ঠিকই, তবে মেয়ের লাশ নিয়ে। আমার বেঁচে থাকার আর শক্তি নাই’, ডুকরে ডুকরে কেঁদে বলছিলেন অসহায় নারায়ণ রায়।