ধোঁয়ায় দরজা খুলতে পারেননি লিটন, দমবন্ধেই মৃত্যু
রাজধানীর মগবাজারের দিলু রোডের বাসাটিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সময় গ্যারেজের পাশে নিজের ছোট কক্ষে ঘুমিয়ে ছিলেন আবদুল কাদের লিটন (৪০)। এর মধ্যে আগুন লেগে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে ধোঁয়া। বুঝতে পেরেই বাঁচার চেষ্টা করেন লিটন। কিন্তু তাঁর কক্ষেও ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ায় দরজা খুলতে সক্ষম হননি তিনি। আগুনে পুড়ে না গেলেও ধোঁয়াতেই কক্ষের ভেতরে মৃত্যু হয় তাঁর। পরে ওই কক্ষ থেকে লিটনের লাশ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। আজ বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) মর্গ থেকে তাঁর লাশ শনাক্ত করেন স্বজনরা।
লিটন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পশ্চিম নন্দনপুর এলাকার বাসিন্দা। তাঁর দুই সন্তান রয়েছে। ছোট ছেলে কলেজছাত্র আফাজ উদ্দিন রনিকে (১৮) নিয়ে কিছুদিন আগেও মগবাজারে থাকতেন তিনি। আর্থিক সংকটের কারণে দুই থেকে তিন মাস আগে ছেলেকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে দিলু রোডের ওই বাসার নিচতলার গ্যারেজের পাশের ছোট একটি কক্ষে থাকতে শুরু করেন লিটন।
লিটনের শ্যালক মো. জহির আলম জানান, ৮ থেকে ১০ বছর ধরে ওই ভবনের নিচতলা ও দ্বিতীয় তলায় ক্ল্যাসিক ফ্যাশন ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি বায়িং হাউসে অফিস সহকারী হিসেবে চাকরি করতেন লিটন। সেখান থেকে প্রতি মাসে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা বেতন পেতেন। ছোট ছেলে রনি মাধ্যমিক পাস করার পর তাকে ঢাকায় আসেন তিনি, ভর্তি করান তেজগাঁও কলেজে। ছেলেসহ একসঙ্গে থাকার জন্য মগবাজার এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন লিটন। দুই থেকে তিন মাস আগে ছেলের পরীক্ষা শেষ হওয়ায় ও আর্থিক সমস্যার কারণে ছেলেকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। পরে তিনি অফিসের নিচতলায় গ্যারেজের পাশের ছোট কক্ষ নিয়ে থাকতে শুরু করেন।
জহির আলম আরো বলেন, ‘দুবছর আগে বড় মেয়ে সোনিয়াকে বিয়ে দেন লিটন। ধারদেনা করে বাড়িতে একটি টিনশেড ঘরও তৈরি করেন। তখন থেকেই ঋণে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এখনো প্রায় চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে। স্ত্রী মরিয়মের কাছে বেতনের টাকা পাঠাতেন তিনি। তিন-চার মাস পরপর নিজেই বেতন পেয়ে বাড়িতে যেতেন। বাড়িতে গেলে দু-তিন দিন থাকতেন। এভাবেই ধারদেনা শোধ করছিলেন লিটন।’
জহির বলেন, ‘লিটন ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আমরা তিন-চার ভাই মিলে বিভিন্ন সময় আর্থিক সহায়তা করতাম। তাঁর এই মৃত্যুতে পরিবারটির ভবিষ্যৎ কোথায় দাঁড়াবে, তাই এখন চিন্তার বিষয়।’
ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ বাড়িতে নিয়ে যেতে চায় লিটনের পরিবার। তাঁর ভাতিজা মো. নুরনবী বলেন, ‘আমার চাচাকে তো কেউ মেরে ফেলেনি, দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। আমরা তাঁর লাশটি নিয়ে সুন্দর মতো লক্ষ্মীপুরে বাড়িতে যেতে চাই। সেখানে তাঁর লাশের দাফন করব। পুলিশকে বলেছি, ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশটি আমাদের দিয়ে দিতে। তারা আমাদের এখনো কিছু বলছে না।’
মগবাজারের দিলু রোডের ওই ভবনে আজ বৃহস্পতিবার ভোররাত ৪টার দিকে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ সময় শিশুসহ তিনজন নিহত হন। দগ্ধ হন আরো দুজন। এ ছাড়া ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়েছেন শিশুসহ আরো চারজন। তাঁরা সবাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। ভবনের গ্যারেজ থেকে এ আগুন লাগে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান, আগুনে দুজন দগ্ধ হয়েছেন। এ ছাড়া চারজন ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়েছেন। তাঁরা বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন।
লিটন ছাড়া নিহত অন্য দুজনের মধ্যে একজন হলো চার বছর বয়সী শিশু এ কে এম রুশদি। নিহত আরেকজনের নাম জানা যায়নি।
দগ্ধ দুজন হলেন নিহত রুশদির বাবা শহিদুল কিরমানি রনি (৪০) ও মা জান্নাতুল ফেরদৌস (৩৮)। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন চারজন হলেন কাঁচামাল ব্যবসায়ী মনির হোসেন (৪০), তাঁর স্ত্রী সুমাইয়া আক্তার (৩০), তাঁদের ৯ মাস বয়সী ছেলে মাহমুদুল হাসান ও মাহাদী হাসান রিফাত (৯)।
নিহত শিশু রুশদির দাদা এ কে এম শহিদুল্লাহ জানান, রুশদি স্থানীয় একটি স্কুলে প্লে শ্রেণিতে পড়াশোনা করত। দগ্ধ জান্নাতুল ও শহিদুলের একমাত্র সন্তান সে। তাঁরা নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার ইটনা গ্রামের বাসিন্দা।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক সামন্তলাল সেন জানান, দগ্ধ দুজনের মধ্যে একজন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ও আরেকজন হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) চিকিৎসাধীন। জান্নাতুলের শরীরের ৯৫ শতাংশ ও শহিদুলের শরীরের ৪৩ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। তাঁদের দুজনেরই শ্বাসনালি মারাত্মকভাবে পুড়ে যাওয়ায় অবস্থা গুরুতর।
সামন্তলাল সেন আরো বলেন, ‘এ অবস্থা থেকে রোগীর রিকভারি করার সম্ভাবনা খুব কম। তবুও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’