‘ধুকছে’ প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনাল
বিচারকের কোরাম পূর্ণ ছাড়া বিচারকাজ চালানো যায় না। কোনো মামলার বিচারকাজ করতে হলে তিনজনের পূর্ণ বিচারক প্যানেল প্রয়োজন। কিন্তু দেশের একমাত্র প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে চেয়ারম্যান আছেন তো সদস্য নেই। সদস্য আছেন তো চেয়ারম্যান নেই। দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই ধুকছে গুরুত্বপূর্ণ এই ট্রাইব্যুনাল।
সরেজমিনে জানা যায়, গত প্রায় ছয় মাস ধরে প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান পদ শূন্য রয়েছে। এর আগে দুই সদস্যের মধ্যে একজনের পদ শূন্য ছিল তিন মাস। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে সদস্য পদে একজন ট্রাইব্যুনালে যোগদান করেন। কিন্তু আগস্ট থেকে ফের চেয়ারম্যানের পদ খালি হয়ে যায়। আর এ কারণে বাড়ছে মামলার জট, বাড়ছে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি।
সংবিধানের ১১৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল আইনের ৫ ধারা অনুসারে, একজন চেয়ারম্যান এবং দুজন সদস্যের সমন্বয়ে এই ট্রাইব্যুনাল গঠিত হবে। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হবেন এমন ব্যক্তি, যিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বা বিচারপতি হওয়ার যোগ্য। সদস্যদের একজন হবেন জেলা ও দায়রা জজ এবং আরেকজন প্রজাতন্ত্রে কর্মরত এমন এক কর্মকর্তা, যার পদমর্যাদা যুগ্ম সচিবের নিচে নয়।
সরকারি বা বিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবীদের নিয়োগ, পদোন্নতি, অপসারণ ও অব্যাহতি, পেনশন বা বিভাগীয় মামলাসহ বিভিন্ন ধরনের মামলার বিচার হয় দেশের মোট সাতটি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে। এর মধ্যে ঢাকায় (১, ২ ও ৩) তিনটি, অন্য চারটি চট্টগ্রাম, খুলনা, বগুড়া ও বরিশালে। এসব ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল নিষ্পত্তির জন্য রয়েছে একমাত্র প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনাল। পিওন থেকে সচিব পর্যন্ত সরকারি যে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের চাকরি নিয়ে প্রশাসনিক কোনো সংকটে পড়লে এই ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হয়ে থাকেন।
ট্রাইব্যুনাল আইনে বলা আছে, একজন চেয়ারম্যান ও দুই সদস্যসহ তিনজনের সমন্বয়ে বসবে প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ। কোনো কারণে চেয়ারম্যান অথবা অন্য দুই সদস্যের যে কোনো একজন অনুপস্থিত থাকলে ট্রাইব্যুনাল বসবে না। এ বিষয়ে আইনে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় চেয়ারম্যান কিংবা কোনো সদস্যের অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন বিচারকাজ বন্ধ থাকলে একদিকে যেমন বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি বেড়ে যায়, তেমনি প্রতিদিন নতুন নতুন মামলা জমা হয়ে লেগে যায় মামলাজট।
ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, বিদায়ী চেয়ারম্যান হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ কে এম ফজলুর রহমান ২০১৯ সালের ৮ আগস্ট অবসরে যান। এর আগে তিনি দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। তাঁর স্থলে এ পর্যন্ত নতুন কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে চেয়ারম্যান পদ শূন্য রয়েছে গত প্রায় সাত মাস ধরে। বর্তমানে দুজন সদস্য রয়েছেন। তাঁরা হলেন- রুনা নাহিদ আক্তার ও আলতাফ হোসেন চৌধুরী।
এর আগে এপ্রিল মাসে প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আলতাফ হোসেন চৌধুরীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগের তিন মাস পর জুলাই মাসে তিনি এ কর্মস্থলে যোগদান করেন। ফলে কোরামের অভাবে তিন মাস ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ বন্ধ ছিল। এখন চেয়ারম্যানের অভাবেও বন্ধ রয়েছে বিচারকাজ।
ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে সাড়ে সাত শতাধিক মামলা বিচারাধীন রয়েছে। প্রতিমাসে কমপক্ষে ৩০-৪০টি মামলা নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। একটি মামলা নিষ্পত্তি করতে কমপক্ষে সময় লাগে ২-৩ বছর। ততদিনে বিচারপ্রার্থীর বেহাল দশা!
এ বিষয়ে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট স্বপন কুমার আইচ বলেন, ‘চেয়ারম্যান না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে আপিল ট্রাইব্যুনাল বসছে না। অভিভাবক শূন্য থাকায় আপিল ট্রাইব্যুনালে মামলাও বেশ জমেছে। বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ লাঘব করতে অবিলম্বে দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন একজন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।'
ট্রাইব্যুনালের ৫ (৩) ধারা মতে, অভিজ্ঞ একজন আইনজীবীকে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে আইনজীবীরা জানিয়েছেন, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে চেয়ারম্যান পদে চুক্তিভিক্তিক নিয়োগ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এমন নিয়োগকে অসাংবিধানিক উল্লেখ করে সম্প্রতি একজন আইনজীবী সরকারের আইন সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্নিষ্টদের প্রতি লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন।
এদিকে প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে জনবল সংকটের পাশাপাশি রয়েছে নানা সমস্যা। ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালটি সচিবালয়ের বিপরীতে রেল ভবনের পশ্চিমে ১৪ আব্দুল গণি রোডে অবস্থিত। প্রায় ২০০ বছরের পুরনো দোতলা ভবনের ওপর তলায় নিরীক্ষক অধিদপ্তরের প্রধানের কার্যালয় এবং নিচতলায় প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও দুজন সদস্যের চেম্বার।
চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত এ দুর্বল ভবনটি যে কোনো সময় ধসে পড়তে পারে। এমন ঝুঁকি মাথায় নিয়ে অফিস করছেন সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এসব সমস্যা নিরসনে সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি ও আইন মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। সংশ্নিষ্টদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের একাধিক কর্মকর্তা ও আইনজীবী।