দুই পুলিশ কর্মকর্তার করোনা জয়, লড়াইয়ের নায়ক যে পুলিশ সুপার
‘স্যার, আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হয়, আমি মারা যাচ্ছি।’ রাত আড়াইটায় ফোন করে জেলার পুলিশ সুপারকে (এসপি) কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে এমনটিই বলছিলেন আইসোলেশন ওয়ার্ডে মৃত্যুভয়ে শঙ্কিত শেরপুরের ঝিনাইগাতী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) তোফায়েল হোসেন।
সেই রাতে আর ঘুমাতে পারেননি এসপি কাজী আশরাফুল আজীম। দীর্ঘ সময় টেলিফোনে তাঁকে সঙ্গ দিয়েছেন। মানসিকভাবে সাহস জুগিয়েছেন।
ভোর না হতেই এসপি খবর নিয়েছেন আক্রান্ত পুলিশ কর্মকর্তার পরিবারের সদস্যদের। ফুল, ফল আর খাবার নিয়ে নিজেই ছুটে গেছেন হাসপাতলে। সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে আক্রান্ত পুলিশ কর্মকর্তার সামনে দাঁড়িয়েছেন। নিয়েছেন চিকিৎসার খোঁজখবর।
কেবল তোফায়েল আহমেদ নন। তাঁর মতো ঝিনাইগাতী থানার আরেক এসআই সাইদুর রহমান খানকেও সার্বক্ষণিক ছায়ার মতো আগলে রেখেছেন এসপি। নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে তাঁদের সঙ্গে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে কথা বলেছেন। যোগাযোগ রেখেছেন, করোনায় আক্রান্ত দুই পুলিশ কর্মকর্তার পরিবারের স্বজনদের সঙ্গেও। পুলিশ সুপারের তত্ত্বাবধানে বাচ্চাদের জামা-কাপড় থেকে শুরু করে বাসার কাঁচাবাজারও নিয়মিত পৌঁছে গেছে করোনা আক্রান্ত দুই পুলিশ কর্মকর্তার বাড়িতে।
এভাবেই আক্রান্ত দুই সহকর্মীর পাশে থেকে তাঁদের নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে অদম্য প্রত্যয়, সাহস আর অনুপ্রেরণা জুগিয়ে কাজী আশরাফুল আজীম নিজেও শামিল হয়েছেন করোনাযুদ্ধে।
পুলিশের ২৪তম ব্যাচের মেধাবী কর্মকর্তা কাজী আশরাফুল আজীম শেরপুর জেলার পুলিশ সুপার। ২০১৮ সালের ৭ জুন পুলিশ সুপার হিসেবে তাঁর যোগদানের পর খোলনলচে পাল্টে যায় জেলা পুলিশের চিত্র। ময়মনসিংহ রেঞ্জে চারবারের শ্রেষ্ঠ পুলিশ সুপারের পুরস্কার অর্জনের পাশাপাশি মানবিক পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর বিভিন্ন পদক্ষেপ সাড়া ফেলে শেরপুরে।
সর্বশেষ তাঁর নেতৃত্বে অসহায় কৃষকদের পাশে দাঁড়ায় শেরপুর জেলা পুলিশ। ধান কাটার উৎসবের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যরা মাঠের ফসল তুলে দেন কৃষকের গোলায়। পাশাপাশি জেলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের বাড়িতেও ফলসহ খাবার সামগ্রী পৌঁছে দেন তিনি। সচেতনতার অংশ হিসেবে চালকদের মাস্ক ব্যবহার ছাড়া পেট্রলপাম্প থেকে কোনো যানবাহনে জ্বালানি না দেওয়ার অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেন তিনি।
গত রোববার ফুলেল শুভেচ্ছায় পুলিশ সুপার বরণ করে নেন করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে সুস্থ হয়ে ফিরে আসা দুই পুলিশ কর্মকর্তা এসআই সাইদুর রহমান খান ও তোফায়েল হোসেনকে।
সম্মুখ সমরে বিজয় বীর হিসেবে আখ্যা দিয়ে বাহিনীর অন্য সদস্যদের কাছে তাঁদের তুলে ধরেছেন অনন্য উচ্চতায়। বিশেষভাবে সম্মানিত করেছেন দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে। কীভাবে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল হতে হবে, ভয় না পেয়ে করোনাকে জয় করতে হবে—সে বার্তাই পৌঁছে দিয়েছেন বাহিনীর সদস্যদের কাছে।
করোনাভাইরাসের সঙ্গে জীবন-মৃত্যুর লড়াই করে জীবন হাতে নিয়ে ফিরে আসা জেলা পুলিশের দুই কর্মকর্তার মুখে পুলিশ সুপারের অনন্য মানবতার গল্প শুনে এখন উজ্জীবিত বাহিনী অন্য সদস্যরাও। জেলা পুলিশ সুপারের সেই মানবিক গুণাবলির কথাই এখন ঘুরে ফিরছে এ মুখ থেকে ও মুখে।
করোনাজয়ী শেরপুর পুলিশের এসআই সাইদুর রহমান খান বলেন, ‘নির্জন আইসোলেশন ওয়ার্ডে প্রথম দিকে সব সময় মৃত্যুভয় ছিল। পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা হলো, দুর্ধর্ষ কোনো খুনির চেয়েও যেন ভয়ংকর করোনাভাইরাস। কারণ, আপনি অস্ত্র দিয়ে খুনিকে মোকাবিলা করতে পারবেন, কিন্তু সময়মতো মানসিক সমর্থন শক্তি আর সাহস ছাড়া এই রোগকে প্রতিহত করা সম্ভব না।’
সাইদুর রহমান বলেন, ‘পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম স্যার আমাকে সব সময় মানসিক সাহস জুগিয়ে গেছেন। সেটা না পেলে হয়তো আমি হেরেই যেতাম। অন্য পাঁচ শহীদ পুলিশ সদস্যের সঙ্গেও আমার নাম যোগ হতো। স্যার এটা হতে দেননি। কখনো মনে হয়নি, তিনি আমাদের পুলিশ সুপার। মনে হয়েছে চিকিৎসক কিংবা মনোবিদ। কখনো ঘনিষ্ঠ স্বজন বা বন্ধুর মতো পাশে থেকে আমাদের সাহস জুগিয়েছেন। চাকরির ২৯ বছরে এমন এসপি আমার জীবনে প্রথম দেখলাম।’
সুস্থ হয়ে আসা আরেক এসআই তোফায়েল হোসেন বলেন, ‘এসপি স্যার যেভাবে আমাকে গভীর রাতেও কাউন্সেলিং করেছেন, সহমর্মিতা জানিয়েছেন, আমার পরিবারের স্বজনদের খোঁজখবর নিয়েছেন, সত্যিই আমি কৃতজ্ঞ ও অভিভূত। বলতে পারেন, ভয়ংকর করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শক্তির উৎসই ছিলেন কাজী আশরাফুল আজীম স্যার।’
করোনাভাইরাসে শেরপুরে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৩০ জন, যাদের তিনজনই পুলিশ সদস্য। দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৪ জন। চিকিৎসাধীন অন্য পুলিশ সদস্য দ্রুত সেরে উঠছেন।
যোগাযোগ করা হলে কাজী আশরাফুল আজীম জানান, করোনাভাইরাসে ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধা হিসেবে প্রায় এক হাজার পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন পাঁচজন। শুরু থেকেই আমি এই বার্তাটা আমার সহকর্মীদের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি যে, একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে যদি আমরা কেউ বিপদগ্রস্ত হই, বিশেষ করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হই, তাহলে আমরা সবাই পরস্পরের পাশে থাকব। প্রধানমন্ত্রী ও পুলিশের আইজিপি আমাদের যে নির্দেশনা দিয়েছেন, সেগুলো আমরা প্রতিপালন করার চেষ্টা করেছি। বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে যাতে মনোবল অটুট থাকে, সবাই মিলে যাতে এই যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারি—সব সময় সেই চেষ্টাটাই করেছি।’
কাজী আশরাফুল আজীম আরো বলেন, ‘সাহস ও প্রত্যয় নিয়ে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে অদম্য লড়াইয়ে বিজয়ী হয়ে যাতে অন্যদের কাছে আমার পুলিশ সদস্যরা অনুপ্রেরণার আলো ছড়াতে পারে, সবাইকে উজ্জীবিত করে করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, সেটাই ছিল আমার একমাত্র লক্ষ্য।’