তিন বন্ধুর স্বপ্নই ছিল বড় সন্ত্রাসী হবে
কিশোর মানেই স্বপ্নের বীজবোনা হৃদয়। সেই হৃদয়ে কতজন কত রঙিন স্বপ্নই তো বোনে। কিন্তু এই তিন কিশোর বুনেছিল নিষিদ্ধ স্বপ্ন। গাজীপুরে খালাকে স্বপরিবারে হত্যা করে লুট করা টাকায় ফ্ল্যাট, পিস্তল ও মোটরসাইকেল কিনে তিন কিশোর বন্ধু একদিন বড় সন্ত্রাসী হতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সেই নিষিদ্ধ স্বপ্ন পূরণ হয়নি। র্যাব-১ এর সদস্যরা তাদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।
নিজের খালাকে খুন করে তার খালুকে কুপিয়ে জখম করার দায়ে ভাগনে ও তার দুই বন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আজ শনিবার র্যাব-১ এর স্পেশালাইজ কোম্পানি পোড়াবাড়ী ক্যাম্পের লে. কমান্ডার আব্দুল্লাহ আল-মামুন এ তথ্য জানিয়েছেন।
গ্রেপ্তারকৃতরা হল ভোলা জেলার সদর থানার ধনিয়া বঙ্গেরচর (নদী ভাঙা) এলাকার মৃত আ. হামিদ বেপারীর ছেলে মো. হোসেন বেপারী ওরফে আপন (১৯), ঢাকা জেলার সাভার থানার ঝাউচর এলাকার মো. সিরাজুল ইসলামের ছেলে মো. রায়সুল ইসলাম রিফাত (১৯) ও মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুর থানার নারায়ণপুর এলাকার মো. জহির রায়হানের ছেলে মো. ইমন রায়হান (১৮)।
র্যাব কর্মকর্তা আরো জানান, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের পশ্চিম বিলাশপুরের শহীদ নিয়ামত সড়ক এলাকার নিজ বাসায় গত ৩ নভেম্বর গৃহবধূ রীনা আক্তারকে (৪৫) গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা এবং তার স্বামী মো. সিদ্দিক বেপারীকে (৫০) ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে পালিয়ে যায় নিহতের ভাগনে ও তার দুই বন্ধু।
এ ঘটনায় জড়িত থাকায় ভাগনের বন্ধু রিফাতকে ঢাকার আশুলিয়া এলাকা থেকে শুক্রবার রাতে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে রিফাতের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আজ ভোরের দিকে মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুর বাজার এলাকায় রায়হানের নানার বাড়ি থেকে রায়হান ও নিহতের ভাগ্নে হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃতরা র্যাবের কাছে ওই খুনের ঘটনা স্বীকার করে পুরো ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে।
পুলিশ এবং আহত সিদ্দিক ব্যাপারীর ভাই গফুর বেপারীসহ স্বজনরা জানান, ভোলার অভিবাসী সিদ্দিক বেপারী স্ত্রী-সন্তান নিয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের পশ্চিম বিলাশপুরে নিজের পাঁচতলা ভবনের তৃতীয় তলার থাকতেন। সিদ্দিক-রীনা দম্পতির তিনি ছেলের মধ্যে বড় দুই ছেলে মানিক ও সোহেল সৌদি প্রবাসী। ছোট ছেলে দেলোয়ার তার স্ত্রীকে নিয়ে একই ফ্ল্যাটে থাকেন। সিদ্দিক বেপারীর বড় ভাই হামিদ বেপারী বিয়ে করেন রীনা আক্তারের পালিত বোন কহিনুরকে। হামিদ বেপারী স্বপরিবারে ঢাকার আশুলিয়া থানার চারাবাগ মুন্সীপাড়া এলাকায় বাস করেন।
র্যাব কর্মকর্তা গ্রেপ্তারকৃতদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, তারা একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও মাদকাসক্ত। বখাটে এ তিন বন্ধুর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে স্বপ্ন জাগে একদিন তারা বড় সন্ত্রাসী হয়ে প্রচুর টাকা আয় করবে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তাদের নাম শোনামাত্র ভয় পাবে। এজন্য তাদের অনেক টাকা প্রয়োজন। তাদের এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য হোসেন তার খালা রীনা আক্তারের গাজীপুরের বাসায় ডাকাতির প্রস্তাব দেয়। তারা ফ্ল্যাট, পিস্তল ও মোটরসাইকেল কিনে বড় সন্ত্রাসী হবে। এজন্য খালা রীনা আক্তারকে স্বপরিবারে হত্যা করে তার বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা ও স্বর্ণালংকার ডাকাতি করার সিদ্ধান্ত নেয়।
র্যাব কর্মকর্তা আরো জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ২ নভেম্বর দুপুরে ভাগনে হোসেন বেপারী তার দুই বন্ধু রিফাত ও ইমনকে নিয়ে গাজীপুরে খালা রীনার বাসায় বেড়াতে যায়। বাসায় পৌঁছে রাতের খাবার খেয়ে তিন বন্ধু ছাদে বসে পরিকল্পনা করে। তাদের প্লানিং ছিল ভোর রাতে হোসেনের খালু সিদ্দিক বেপারী যখন ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে যাবেন তখন প্রথমে খালা রীনাকে হত্যা করবে। তারপর খালু সিদ্দিক বেপারী মসজিদ থেকে বাসায় ফিরলে তাকে হত্যা করবে। এরপর খালাতো ভাই দেলোয়ারকে হত্যা করবে তারা। সবশেষে খালাত ভাইয়ের স্ত্রীকে তিনজন মিলে পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করে তাকেও হত্যা করে নগদ টাকা ও স্বর্ণলংকার নিয়ে পালিয়ে যাবে ওই তিন বন্ধু। পরে ডাকাতির টাকা দিয়ে তারা তিন বন্ধু ফ্ল্যাট, পিস্তল এবং মোটরসাইকেল কিনে তাদের সন্ত্রাসী জীবন পরিচালনা করবে।
এদিকে পরিকল্পনা মতো রোববার ভোরে সিদ্দিক বেপারী নামাজের উদ্দেশ্য বের হলে তার স্ত্রী রীনাকে রশি দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করে বিছানায় শুইয়ে রাখে হোসেন ও তার বন্ধুরা। পরে মসজিদ থেকে ফিরে আসলে সিদ্দিককেও রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করে তারা। এ সময় সিদ্দিককে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপায়। আহত সিদ্দিক মৃত্যুর ভান ধরে ফ্লোরে শুয়ে থাকলে ঘাতকরা বাসার আলমারি ভেঙে নগদ তিন লাখ টাকা ও বিপুল পরিমাণ স্বর্ণলংকার নিয়ে নেয়। পরে তারা দেলোয়ারকে হত্যার উদ্দেশে তার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলে গুরুতর আহত সিদ্দিক বেপারী চিৎকার দেয়। চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে রক্তাক্ত জামা পড়াবস্থায় হোসেন ও তার সঙ্গীরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।
এলাকাবাসী হতাহতদের উদ্ধার করে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক রীনা আক্তারকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত সিদ্দিককে সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকায় নিয়ে ভর্তি করা হয়।
খবর পেয়ে পুলিশ নিহতের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ওই হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। এদিকে এ ঘটনার চার দিন পর র্যাব-১ এর পোড়াবাড়ী ক্যাম্পের সদস্যরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত ওই তিনজনকে গ্রেপ্তার করে।