‘তরুণদের প্রতিনিধি হয়ে বাসযোগ্য নগরী গড়তে চাই’
ইশরাক হোসেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী। পেশায় একজন প্রকৌশলী। তিনি ঢাকা স্কলাসটিকা স্কুল থেকে ‘ও’ লেভেল,এবং ‘এ’ লেভেল শেষ করে লন্ডনের হার্ডশাওয়ার ইউনিভার্সিটি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিএনপিনেতা, সাবেক মন্ত্রী সাদেক হোসেন খোকার ছেলে। সাদেক হোসেন খোকা ছিলেন অবিভক্ত ঢাকার সর্বশেষ মেয়র।
ভোটের মাঠে প্রথমবারের মতো নেমেছেন ইশরাক। তবে এরইমধ্যে নগরী নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা, বাচনভঙ্গি মানুষের নজর কেড়েছে। নির্বাচন ও ঢাকা নিয়ে তাঁর ভবিষ্যৎ পরিবল্পনা নিয়ে রাজধানীর গোপীবাগে নিজের পৈতৃকবাড়িতে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেন ইশরাক হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এনটিভি অনলাইনের সিনিয়র রিপোর্টার জাকের হোসেন।
এনটিভি অনলাইন : আগামী ৩০ জানুয়ারি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী আপনি। নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে আপনি কতটুকু আশাবাদী?
ইশরাক হোসেন : ধন্যবাদ আপনাকে। নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে আমরা বার বার বলে আসছি যে, এ নির্বাচন কমিশনের অধীনে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতা জাতির রয়েছে। আপনারা জানেন, গত ২ জানুয়ারি যেদিন প্রার্থীদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া চলছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে ৩২ নং ওয়ার্ডের একজন কাউন্সিলর পদপ্রার্থীকে সাদা পোশাকের পুলিশ অনুসরণ করে। বাসায় যাওয়ার পথে সাদা পোশাকের পুলিশ তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে একটি হোটেলে আটক করে রাখে। পরক্ষণে থানায় নিয়ে পুরোনো একটি মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। আমরা যে আলামত দেখতে পাচ্ছি; সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ বা লেভেল ফিল্ডের সম্ভাবনা খুব একটা দেখছি না। এ মুহূর্তে আমি নির্বাচন কমিশনকে বলব; এখনো সময় আছে; নির্বাচন কমিশন অতীতের ভুল সংশোধন করে জাতিকে একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন উপহার দেবে।
এনটিভি অনলাইন : আপনি মেয়র নির্বাচিত হলে নগরীকে কী উপহার দেবেন?
ইশরাক হোসেন : প্রথমত আমি নগরীকে একটি বাসযোগ্য নগরী হিসেবে দেখতে চাই। আমরা বিশ্বের অলস নগরীর তালিকায় কেন এক নম্বর থাকব? বিশ্বের দূষিত নগরীর তালিকায় কেন এক নম্বরে থাকব? সবচেয়ে অনিরাপদ নগরীর তালিকায় কেন এক নম্বরে থাকব? নারীদের জন্য সবচেয়ে অনিরাপদ শহর হিসেবেও তালিকায় ঢাকা এক নম্বরে রয়েছে। এ রকম বহু ইনডেক্সেও এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরসহ বহু নিম্নস্তরের শহর রয়েছে তার সমমানের অবস্থা ঢাকার! কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়ে ও আরো বেশি খারাপ অবস্থান রয়েছে। আমি প্রথমত; বাসযোগ্য নগরী গড়ে তুলতে চাই এবং উন্নত শহর দেখতে চাই। আমার পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত শহর দেখার সুযোগ হয়েছে। সেসব শহরের মতো রাজধানী ঢাকাকেও উন্নত শহর হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।
এনটিভি অনলাইন : আপনার মতে, রাজধানীর পাঁচটি সমস্যা কী?
প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন : রাজধানীর বহু সমস্যা রয়েছে। প্রথমত বলব; আপনারা দেখেছেন যে,এ বছর ডেঙ্গু মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেটি আমাদের মশক নিধন যে কার্যক্রম আছে। সেটির ব্যর্থতা। এটিই আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা।
দ্বিতীয়ত, বায়ুদূষণ। কারণ প্রতিনিয়ত আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে দূষিতবায়ু আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে। এখানে ভারী ধাতুসহ বিষাক্ত পদার্থ আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে। এ জন্য বলব, এটি আমাদের অন্যতম সমস্যা।
তৃতীয়ত, পুরান ঢাকার কিছু এলাকা রয়েছে যেখানে ওয়াসার ড্রেনেজ সিস্টেমের আওতায় আসেনি। সেসব জায়গায় বসবাসের একেবারে অনুপযোগী। বৃষ্টির সময় ওসব জায়গায় ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
চতুর্থত, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কথা আমি বলতে চাই। আমাদের যেভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চলছে; খুব গুরুত্বপূর্ণ সড়কেও খোলা অবস্থায় কাঁচাবর্জ্য পড়ে থাকে। এ ছাড়া সিটি কপোরেশনের আওতাধীন কাঁচা বাজারেও এলোমেলোভাবে বর্জ্য পড়ে রাস্তায় দূষণ হচ্ছে। বর্জ্যের কারণে ফুটপাত দিয়ে সাধারণ মানুষ হাঁটাচলা করতে পারে না।
পঞ্চমত, সর্বশেষ ট্রাফিক ব্যবস্থার কথা বলব। আপনারা দেখবেন যে, ট্রাফিক জ্যামের কারণে প্রতি বছর আমরা ৩৩ বা ৩৭ হাজার কোটি টাকার লোকসান গুনছি এবং লাখ লাখ কর্মঘণ্টা অপচয় হচ্ছে। কারণ ঢাকা শহর ট্রাফিক জ্যামের নগরী হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে।
এনটিভি অনলাইন : মেয়র পদপ্রার্থীদের মধ্যে আপনি তরুণ। আগামী প্রজন্মের তরুণদের নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
ইশরাক হোসেন : আমাদের জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি তরুণ বয়সে, এত অল্প বয়সে আমাকে এত বড় দায়িত্ব দিয়েছে। নিশ্চয়ই আমাদের দলের একটি চিন্তাভাবনা রয়েছে। তারমধ্যে অন্যতম হলো বর্তমান তরুণ প্রজন্ম রাজনীতিবিমুখ হয়ে যাচ্ছে। আমাকে দেখে তরুণ প্রজন্মও উৎসাহ পাবে। আমিও চেষ্টা করব তরুণদের সচেতন করার জন্য। দ্বিতীয়ত তরুণরা যেন আমাকে দেখে আশাবাদী হয় যে; তরুণ বয়সেও মেয়র পদপ্রার্থী হওয়া সম্ভব। সেহেতু এ বয়সে সব কিছুই করা সম্ভব। এ মুহূর্তে তরুণ বয়সে আমাদের শক্তিমত্তা, বুদ্ধিমত্তা সবই রয়েছে। তাই এ বয়সে কাজ করা সম্ভব। তরুণদের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করেই বসবাসের যোগ্য নগরী গড়ে তুলতে চাই।
এনটিভি অনলাইন : রাজধানীতে সুপেয় পানির অভাব। সুপেয় পানি উৎপাদনে ওয়াসা কি ব্যর্থ?
ইশরাক হোসেন : ওয়াসা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। যদি আমি মেয়র নির্বাচিত হই তাহলে এ নগরীর মানুষের প্রতি আমার একটি দায়বদ্ধতা থাকবে। ওয়াসার সঙ্গে নিয়মিত বসব। দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে নেব। আপনারা জানেন যে, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে অনেক ওয়ার্ড যুক্ত হয়েছে। এ বিশাল অঞ্চল ওয়াসার নেটওয়ার্কের বাইরে। ওয়াসার সুয়ারেজ এবং ওয়াটার সাপ্লাই পৌঁছেনি। সুপেয় পানির বাইরে তাঁরা। সেসব অঞ্চলসমূহকে কীভাবে ওয়াসার নেটওয়ার্কের মধ্যে আনা যায় সেই ব্যবস্থা করব। আপনারা দেখবেন যে,ওয়াসার পানি এবং সুয়ারেজের পাইপ লাইন অনেক সময় মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। সে কারণে আমরা পানিতে দুর্গন্ধ পাই। আমরা ওয়ার্ডভিত্তিক জরিপ চালিয়ে শনাক্ত করব কোন কোন জায়গায় ওয়াসার দুর্বলতা রয়েছে। কোন ওয়ার্ডে সুয়ারেজ এবং পানির সাপ্লাইয়ের সমস্যা রয়েছে, তা শনাক্ত ও সমাধান করার চেষ্টা করব।
এনটিভি অনলাইন : আমরা দেখে আসছি; বিরোধীদল থেকে কেউ নির্বাচিত হলে ওই এলাকার উন্নয়নের জন্য বাজেট পেতে সমস্যা হয়। সেক্ষেত্রে আপনি যদি বাজেট না পান তাহলে কীভাবে মোকাবিলা করবেন?
ইশরাক হোসেন : দেখুন অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে ঢাকাকে একইভাবে দেখলে চলবে না। কারণ অনেক দূরের উদাহরণ আপনি দিতে পারেন। কিন্তু ঢাকার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ এটা আমাদের রাজধানী। ঢাকাকেই কেন্দ্র করেই পুরোদেশ পরিচালিত হয়ে থাকে। আমাকে মেয়র নির্বাচিত করলে আমার সবচেয়ে বড় শক্তি হবে আমার জনগণ। আমার জবাবদিহিতাও থাকবে জনগণের কাছে। যেকোনো সমস্যা সমাধানে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করব। নাগরিকদের যেসব অধিকার রয়েছে তা যেকোনভাবেই আদায় করব। কারণ আপনি জানেন যে,আমার বাবা তিনটি সরকারের আমলে মেয়রপদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মেয়র হিসেবে এতই সফল ছিলেন যে, ভোটের মাধ্যমে মেয়র পদ থেকে তাঁকে সরানো সম্ভব ছিল না বিধায় রাজধানী সিটিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আমি আমার বাবার আদর্শ ও নীতি নিয়ে বড় হয়েছি এবং তিনি মেয়র থাকাকালীন যেসব কর্মপন্থা অবলম্বন করেছেন, আমিও সেটি করব। এতে কোনো সমস্যা হবে না বলে আমি মনে করি।
এনটিভি অনলাইন : অবিভক্ত ঢাকার মেয়র হিসেবে সাদেক হোসেন খোকার সফলতা অনেক। তাঁর কোন কাজটি আপনাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করে?
ইশরাক হোসেন : উনার (সাদেক হোসেন খোকার) বহুকাজ আমাকে অনুপ্রাণিত করে। উনি মারা যাওয়ার পর তা বুঝতে পেরেছি। তিনি মানুষের বিপদে আপদে, দুর্দিনে পাশে দাঁড়াতেন। এসব সেবা তিনি চুপিসারে করে গেছেন। কাউকে প্রকাশ করতেন না। তিনি কাউকে বুঝতে দেননি, কারো জন্য তিনি উপকার করেছেন। যখন বাবা মারা গেল তখন মানুষ এসে আমার কাছে এসব কথা বলছে। এ বিষয়টি আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। কেননা মানুষের পাশে থেকে সাহায্য সহযোগিতা করার মতো আনন্দ আর কিছুতেই নেই। জনগণের জন্যই রাজনীতি করা, এটি আমার জন্য অনুপ্রেরণার উৎসাহ হয়ে থাকবে।
এনটিভি অনলাইন : ভোটারদের উদ্দেশে কী বলবেন?
প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন : ভোটারদের উদ্দেশে বলতে চাই, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। ঢাকার নেত্বত্বের কেন্দ্রবিন্দু ছিল পুরান ঢাকা। আজকে যে সংকটময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে; ভোটের অধিকার নেই; গণতন্ত্র নেই, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে; সেটি থেকে যদি আমরা উত্তরণ ঘটাতে চাই তাহলে ঢাকার নাগরিকদের সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। আমি তাদের আহ্বান জানাচ্ছি, আপনাদের সন্তান হিসেবে আপনারা আমাকে ভোট দিবেন। নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা, দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য সবসময় মাঠে থাকব। এ ছাড়া জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার আমি সব ব্যবস্থা নেব।
এনটিভি অনলাইন : আপনার দৃষ্টিতে ভবিষ্যৎ ঢাকা কেমন হওয়া উচিত?
ইশরাক হোসেন : এটা তো খুবই স্বাভাবিক। আমার দৃষ্টিতে ঢাকা যেভাবে দেখতে চাই। আপনিও সেভাবে দেখতে চান। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী যিনি রয়েছেন; তিনিও উন্নত বাসযোগ্য নগরী দেখতে চান। এতে কারো দ্বিমত নেই। আমরা চাই জনগণের যে সার্ভিস প্রোভাইডিং রয়েছে; সেগুলো যেন জনগণের দরজায় পৌঁছে দিতে পারি। আমি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখেছি; যেসব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে; তারা কিন্তু সেবা দেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকবে। বিপরীতে ঢাকার সেবাদানকারী কোনো প্রতিষ্ঠানে গেলে আপনি দেখবেন, তারা এমন একটা আচরণ করবে আপনি অনেকটা তাদের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন। কাকুতি মিনতি করেই সেবা নিয়ে আসতে হয়। আমি নির্বাচিত হলে সে বিষয়গুলোতে পদক্ষেপ নেব।
এনটিভি অনলাইন : সময় দেওয়ার জন্য এনটিভি অনলাইনের পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ইশরাক হোসেন : এনটিভি অনলাইন এবং এ জনপ্রিয় নিউজপোর্টালের পাঠকদেরও অনেক ধন্যবাদ।