ছেলেদের হারিয়েছেন, নাতিদের জন্য ধরেছেন সংসারের হাল
চকবাজারের চুড়িহাট্টায় হাজি ওয়াহেদ ম্যানশনে পশ্চিমপাশে এম আর টেলিকম সার্ভিসের দোকানটি। একেবারে ওয়াহেদ ম্যানশনের ভবন লাগোয়া। মাসুদ রানা ও মাহবুবুর রহমান রাজু এই দুই ভাই মিলে মোবাইল কেনাবেচার দোকানটি চালাতেন। রানা ও রাজুর বাবা সাহেব উল্লাহ সেদিন রাতে দুই ছেলের সঙ্গে দোকানে গল্প করছিলেন। এক সময় দোকান থেকে বের হয়ে যান।
ঠিক আট মিনিট পর সাহেব উল্লাহ জানতে পারেন ওয়াহেদ ম্যানশনের আগুন লেগেছে। তখনো বাসায় পৌঁছাননি তিনি। দ্রুত ছড়িয়ে পড়া আগুন থেকে বাঁচতে রানা ও রাজু দোকানের শাটার নামিয়ে ভেতরে বসে থাকেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ওই দোকানেই মারা যান দুই ভাই।
সাহেব উল্লাহ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘একটু দেরি হলে আমিও আমার ছেলেদের সাথে না ফেরার দেশে চলে যেতাম। রানা-রাজুর দুই এতিম বাচ্চার জন্য হয়তো আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।’
সাহেব উল্লাহর পরিবারে এখন আছে রানা ও রাজুর স্ত্রী। আর আছে তাঁর দুই নাতি। রানার ছেলের বয়স পাঁচ বছর। আর রাজুর ছেলের বয়স প্রায় তিন মাস। বিয়ের মাত্র ২৪ দিনের মাথায় মারা যায় রাজু।
সাহেব উল্লাহ বলেন, ‘দুই নাতি আর ছেলের বউদের নিয়ে বেঁচে আছি। আমি ছাড়া এই এতিমগুলোকে দেখার কেউ নেই। কে ওদের দেখবে?’
ফেব্রুয়ারির কালোরাত
২০১৯ সালে পুরান ঢাকার বুকে নেমে এসেছিল বিভীষিকাময় এক রাত। দেশজুড়ে তখন চলছিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের প্রস্তুতি। ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে চুড়িহাট্টার হাজি ওয়াহেদ ম্যানশন নামের একটি পাঁচতলা ভবনের নিচতলা থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূচনা হয়। ঘটনার পর ১৩টি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের ৩৭টি ইউনিট প্রায় পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। এতে বিমান বাহিনীর দুটো হেলিকপ্টারও ব্যবহার করা হয়। সরু গলি-রাস্তা হওয়ার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের বেশ বেগ পেতে হয়। শুরুতে ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হলেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত ৬৭ জনের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন চকবাজার থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করবে বলে জানায়। এরমধ্যে তিনজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
ঠিক এক বছর পর ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, আগুনের ক্ষত চিহ্ন নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে ওয়াহেদ ম্যানশন। এর উল্টোপাশে থাকা একটি ফার্মেসি একেবারেই পুড়ে যায়। সেই ফার্মেসিতেও ছিল একাধিক মরদেহ। সেই ফার্মেসিও ধ্বংসের চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চুরিহাট্টার গলিতে মানুষের কর্মব্যস্ততা প্রাণ চাঞ্চল্যতা রয়েছে স্বাভাবিক। তবে বছর ঘুরে সেই দিনটি আবার এসেছে। আর এ কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের চোখে মুখে শোক আর ক্ষত চিহ্ন। দোকানগুলোর সামনে টানানো রয়েছে শোকের ব্যানার।
হাতে ছিল মেহেদির রং
সাহেব উল্লাহর ছোট ছেলে রাজু মাত্রই বিয়ে করেছিল। গত বছর ২০ ফেব্রুয়ারি রাজুর বিয়ের বয়স ছিল মাত্র ২৪দিন। তাঁর স্ত্রীর নাম সুলতানা আফরোজ স্মৃতি। গত বছরের ২৮ জানুয়ারি বকশিবাজার এলাকায় একটি কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে হয় রাজু আর স্মৃতির।
বিয়ের আনন্দের রেশ না কাটতেই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হলেন স্মৃতি। চোখের নিমিষে বিধবা হয়ে গেলেন। শোকে পাথর হয়ে যান। ওই শোকের মধ্যেই জানতে পারেন তিনি অন্তঃসত্ত্বা। গত ৯ নভেম্বর তাঁর কোলজুড়ে আসে এক ছেলে সন্তান। বাবার নামের সঙ্গে মিল রেখে তার নাম রাখা হয় মো. হাবিবুর রহমান আফরাজ। বাবাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি আফরাজের। ঠিক যেমন হতভাগ্য বাবা রাজু। এখন সেই আফরাজকে নিয়েই জীবন সংগ্রামে টিকে আছেন স্মৃতি।
একই অবস্থা সাহেব উল্লাহর বড় ছেলে মাসুদ রানার স্ত্রী শাহজাদা আক্তার মুন্নির। তাঁদের বিয়ের সাত বছরের মাথায় একটি ছেলের জন্ম হয়। ছেলের নাম সামছুল আরেফিন। তার বয়স পাঁচ বছর। একই পরিবারে দুই শিশুই তাদের বাবাকে হারিয়ে এতিম। স্মৃতি আর মুন্নি বুঝতে পারছেন সামনের পথটা বেশ কঠিন। তবে তাঁদের শ্বশুর সাহেব উল্লাহ বটবৃক্ষের মতো আগলে রেখেছেন তাঁদের।
দিন চলছে অভাব অনটনে
রানা ও রাজু দুই ছেলেই ছিল পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ছেলেদের হারিয়ে এখন ওই পরিবার অভাব-অনটনে দিন পার করছে। ছোট্ট দুই নাতির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই কোনো রকমে সংসারের হালটা ধরেছেন সাহেব উল্লাহ। ওই এলাকাতেই প্লাস্টিকের ছোটখাটো ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়েছেন।
সাহেব উল্লাহ বলেন, ‘মেয়র সাঈদ খোকনসহ সরকারের এবং ব্যক্তিগতভাবে অনেকে আশা দিয়েছিল। সবই হতাশায় পরিণত হয়েছে। কিছুদিন যাওয়ার পর কেউ আর মনে রাখেনি। নিজেদের ফোনের দোকানেই একসঙ্গে প্রাণ গেছে ওদের।’ তিনি বলেন, ‘আগুন লাগার ঘটনা ঘটে বুধবার। পরের দিন বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দুজনের লাশ শনাক্ত করি।’
সাহেব উল্লাহর বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী এলাকায়। স্বাধীনতার পর থেকেই সপরিবারে চকবাজার এলাকায় বসবাস করেন। রানা ও রাজু ছাড়া তাঁর আরেকটি ছেলে আছে। তাঁর নাম মিরাজ। তিনি এখনো পড়াশোনা করছেন।
এদিকে রানা-রাজুর মতো আরো অনেক পরিবার হারিয়েছেন নিজেদের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে। এরমধ্যে একজন ছিলেন কুমিল্লার বাসিন্দা কাজী এনামুর রহমান। কথা হয় তাঁর ছেলে কাজী ইউসুফের সঙ্গে। এনটিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘আমার বাবার সাথে আমি চকবাজার এলাকায় ব্যবসা করতাম। ঘটনার দিন আমি বিকেলে কুমিল্লা চলে যাই। পরে জানতে পারি, আমার বাবা চুরিহাট্টা মোড়ে একটি ডেন্টালের দোকানে চিকিৎসা শেষে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বের হন। পরে ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে হোটেলে যান। কিছু বুঝে উঠার আগেই বিকট শব্দে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। দৌঁড়াতে গিয়ে মাথার ওপর ইট এসে পড়ে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। আগুন টের পেয়ে দৌড়ে গলি থেকে বের হওয়ার চেষ্টাও করেন। এরইমধ্যে ফোনে তিনি এসব আমাকে জানানও। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই ফোন বন্ধ হয়ে যায়। পরের দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বাবার লাশ শনাক্ত করি।’
ছবি ক্যাপশন : চুড়িহাট্টার আগুনে হারিয়েছেন নিজের দুই যুবক ছেলেকে। দুই ছেলেরই দুটি শিশু সন্তান আছে। আছে দুই ছেলের স্ত্রী। এই সংসারের হাল ধরেছেন সাহেব উল্লাহ। ছবি : মোহাম্মদ ইব্রাহিম