ছুটিতে গ্রামমুখী ঢল, শঙ্কিত বিশেষজ্ঞরা
করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত বিশ্ব। আতঙ্কিত মানুষ নিজেকে বাঁচাতে মরিয়া। এরই মধ্যে গতকাল সরকার টানা ১০ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। ঘোষণার পর থেকেই ঢাকা ছেড়ে গ্রামের উদ্দেশে ছুটতে শুরু করেছে মানুষ। এই যখন পরিস্থিতি, তখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় আক্রান্ত শহরের মানুষদের গ্রামে ফেরা এবং সেখানে গিয়ে অসচেতনভাবে ঘোরাফেরা এই মহামারিকে আরো ভয়ঙ্কর করে তুলতে পারে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন হুমায়ুন কবীর। তিনি আজ মঙ্গলবার সকালে গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। যাওয়ার সময় কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, ‘আমার শরীরে এখনো করোনাভাইরাস প্রবেশ করেনি। তবে ঢাকায় প্রবাসী নয়, এমন মানুষ থেকে অন্য মানুষে সংক্রমণ শুরু হয়েছে। তাই আমি যাতে আক্রান্ত না হই, সে জন্য আগে থেকেই গ্রামে চলে যাচ্ছি। গ্রামে এখনো ভাইরাসটি সেভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। তাই গ্রামে গিয়ে অন্তত মুক্ত বাতাসে ঘুরতে পারব, থাকতে পারব।’
হুমায়ুন কবীরের বক্তব্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সীকে জানানো হয়। হুমায়ুনের বক্তব্য শুনে তিনি এই পরিস্থিতিকে ভয়ঙ্কর আখ্যা দিয়ে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এ ধরনের মনোভাব আর পরিস্থিতি মহামারি আকার ধারণ করা করোনাভাইরাসকে আরো ভয়ঙ্কর করে তুলতে পারে। এ মনোভাব এখনই ত্যাগ করে সচেতন হওয়া জরুরি। না হলে পরিস্থিতি ভীষণ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। কারণ, আমরা একেবারেই সচেতন নই।’
সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, “ঢাকায় কমিউনিটি ট্রান্সমিশন (প্রবাসী নয় এমন মানুষ থেকে অন্য মানুষে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ) শুরু হয়েছে। সুতরাং ঢাকা থেকে গ্রামে ফেরা মানুষের ভেতরে ভাইরাসটি যে সংক্রমিত হয়নি, তার গ্যারান্টি কী? গ্যারান্টি যদি না থাকে, তাহলে গ্রামে ফেরা হুমায়ুনদের উচিত বাড়িতে গিয়ে ছুটি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত ‘হোম কোয়ারেন্টিন’ নিশ্চিত করা। পরিবারের কারো খুব কাছাকাছি না যাওয়া। বাড়িতে আত্মীয়স্বজনকে আসতে নিষেধ করা জরুরি। আপনার মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার যথেষ্ট আশঙ্কা থাকতে পারে। একই সঙ্গে পরিবারেরও উচিত, যতটা সম্ভব গ্রামে ফেরা মানুষের বেশি সংস্পর্শে না যাওয়া।’
ঢাকা থেকে কুষ্টিয়ায় যাচ্ছেন নাজমুল হোসেন। যাওয়ার আগে তিনি বলছিলেন, ‘গ্রামে যাচ্ছি মায়ের আকুতির কারণে। কিন্তু ভয় পাচ্ছি, আমার মাধ্যমে যদি কারো মধ্যে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে! মাকে আমি কীভাবে বলব, তুমি আমার পাশে বসো না বা কাছে এসো না?’
নাজমুল হোসেনের কথা জানানো হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানাকে। তিনি বলেন, ‘সরকার ১০ দিন ছুটি দিয়েছে এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে যাতে মানুষ চলাফেরা না করে। ছুটির উদ্দেশ্য কিন্তু মানুষকে গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া নয়। বরং একজন যে ঘরে ছিলেন, তাঁকে সে ঘরেই রাখা। কিন্তু মানুষ চলাচল শুরু করেছে। মানুষকে বলেও পারা যাচ্ছে না। আমার তো মনে হচ্ছে, শহর ছেড়ে গ্রামে ফেরা মানুষগুলো গ্রামকে শহরের চেয়ে ভয়ঙ্কর করে তুলতে পারে। এ পরিস্থিতিতে ঢাকার মানুষদের গ্রামে ফেরা ঠিক হচ্ছে না।’
নিয়ন্ত্রণ যখন করা যাচ্ছে না, সে পরিস্থিতিতে কী করা উচিত জানিয়ে নাসিমা সুলতানা আরো বলেন, ‘করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর স্বজনরা মৃত ব্যক্তিকে শেষ দেখাও দেখতে পারছেন না। সুতরাং এর চেয়ে ভালো, অন্তত ১৪ দিন মা ও পরিবারের বর্তমান পরিস্থিতি বোঝা, সতর্ক থাকা। শহর থেকে গ্রামে ফেরা মানুষকে পরিবার থেকেই উদ্যোগী হয়ে হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা উচিত। এতে হয়তো সাময়িক অসুবিধা হতে পারে, কিন্তু ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। আর তা যদি না করা যায়, তাহলে চারদিকে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। ধারণ করতে পারে আরো মহামারি আকার। সুতরাং সচেতন হওয়া ছাড়া আপাতত খুব বেশি পথ খোলা নেই আমাদের সামনে।’
এ বিষয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘যাঁরা শহর থেকে গ্রামে যাচ্ছে, তাদের উচিত হবে লোকজনের সংস্পর্শে না যাওয়া। ঘরের ভেতরে থাকা নিশ্চিত করা। আবার গ্রামে থাকা পরিবারেরও উচিত হবে নিজে সতর্ক অবস্থানে থেকে শহর থেকে আসা ব্যক্তিকে সতর্ক করা এবং তার কাছ থেকে অন্যদের নিরাপদ রাখা।’