চুড়িহাট্টায় নিহতদের ময়নাতদন্তে বছর পার
রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের এক বছর পর নিহতদের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন সম্পন্ন করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে যাচ্ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
শুরুতে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হলেও কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত ৬৭ জনের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন বিকেলে চকবাজার থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করবে বলে আজ বুধবার জানানো হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘৬৭টির মধ্যে তিনটি মৃতদেহের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।’
ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন তৈরি করতে এক বছর সময় লাগার কারণ জানতে চাইলে চিকিৎসক বলেন, ‘ডিএনএ নমুনার প্রতিবেদন আসতে দেরি হওয়ায় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দিতে দেরি হলো। মেডিকেল বোর্ড গঠন করে তখন ময়নাতদন্ত করা হয়েছিল। সেই বোর্ডের দুই চিকিৎসক একজন বরিশালে ও একজন নোয়াখালী বদলি হয়ে যাওয়ায় প্রতিবেদন জমা দিতে একটু বেশি সময় লাগল।’
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে চুড়িহাট্টায় একটি ভবন থেকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন’ নামে একটি পাঁচতলা ভবনের নিচতলা থেকে এই অগ্নিকাণ্ডের সূচনা হয়। এ ঘটনার পর নিহত ব্যক্তিদের মরদেহ ও আহতদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়। সেখানে স্বজনদের কান্না-আহাজারিতে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
ভবনটি নিচতলায় ছিল কেমিক্যালের গুদাম ও প্লাস্টিকের তৈজসপত্র তৈরির উপকরণের (দানা প্লাস্টিক) চারটি দোকান। আগুন দ্রুতই ভবনটির পাশের আনাস হোটেল, রাজ হোটেলসহ উল্টো পাশের চারটি ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে একটি কমিউনিটি সেন্টারও ছিল। হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের ভেতর থেকেই অনেকগুলো মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। দুর্ঘটনায় ভবনের সামনে থাকা দুটি প্রাইভেটকার, দুটি পিকআপভ্যান, ছয়টি মোটরসাইকেল ও ৩০টি রিকশা পুড়ে যায় বলে তখন প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনাতে উঠে এসেছিল।
ঘটনার পর ১৩টি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের ৩৭টি ইউনিট প্রায় পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। এতে বিমান বাহিনীর দুটো হেলিকপ্টারও ব্যবহার করা হয়। সরু গলি-রাস্তা হওয়ার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের বেশ বেগ পেতে হয়।
এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার প্রথম বার্ষিকী পালিত হবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার। এ ঘটনায় নিহতদের প্রতিবেদন তৈরি করতে এক বছর সময় লাগল। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগে আজ দুপুর আড়াইটায় নিজ কার্যালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের চিকিৎসক সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৬৮টি মৃতদেহভর্তি ব্যাগ মর্গে পাঠায় পুলিশ। একটি ব্যাগের মধ্যে একটি লাশেরই খণ্ডিত হাত ছিল। তাই মোট লাশের সংখ্যা ৬৭টি।’
সব লাশেরই ময়নাতদন্ত সম্পন্ন এবং ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয় বলে জানান ঢাকা মেডিকেলের এই ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ। তিনি আরো বলেন, ‘এদের মধ্যে ৪৫টি লাশের চেহারা, পোশাকসহ বিভিন্ন চিহ্ন দেখে শনাক্ত করতে সম্ভব হন স্বজনরা। আর ২২টি মৃতদেহের পরিচয় শনাক্ত করতে ডিএনএ নমুনার জন্য অপেক্ষা করতে হয়।’
‘পরবর্তী সময়ে ডিএনএ নমুনার মাধ্যমে ১৯টি লাশের পরিচয় শনাক্ত করা হয় সম্ভব হয়। তবে বাকি তিনটি লাশের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি,’ যোগ করেন সোহেল মাহমুদ।
যেভাবে চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ড
তখন রাত প্রায় সাড়ে ১০টা। চুড়িহাট্টার নন্দকুমার পাঁচমুখী মোড়ে তখনো তীব্র যানজট। ঘিঞ্জি রাস্তায় আটকে ছিল প্রাইভেটকার, পিকআপ, রিকশা, ঠেলাগাড়ি, মোটরসাইকেলসহ শতাধিক যানবাহন। ঠিক এ সময়েই বিকট এক শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকাটি। ভয়ে মানুষ যে যেভাবে পাড়েন দৌড়ানো শুরু করেন। আহতদের মধ্যে যাদের সেই সক্ষমতা ছিল না, তারা রাস্তার মধ্যেই এদিক-সেদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকেন।
এ ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ফায়ার সার্ভিসের কমিটি করা হয় তিন সদস্যের আর শিল্প মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির সদস্য ছিলেন ১২ জন। এর বাইরে চকবাজার থানায় একাধিক মামলাও হয়।
সে সময় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার ছিলেন আছাদুজ্জামান মিয়া। তিনি ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটনাস্থলে গিয়ে গণমাধ্যমের কাছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘গাড়ির সিলিন্ডার প্রথমে বিস্ফোরণ হয়। তারপর বাঁ পাশে থাকা এসির ট্রান্সফরমারে সেটি হিট করে। সেখান থেকে হিট হয় ট্রান্সফরমারে। এ আগুনটা ছড়িয়ে পড়ে গাড়িতে। পাশের একটি পিকআপে অনেকগুলো গ্যাসের সিলিন্ডার নেওয়া হচ্ছিল। পুরো সিলিন্ডারগুলো একচোটে বিস্ফোরণ হয়ে পাশের হোটেলে আগুন লাগে। হোটেলে চারটা বড় বড় রান্নার সিলিন্ডার ছিল। ওই চারটা সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়ে আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।