ঘরে বসে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সমাধান করতেন তাঁরা
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণের নিশ্চয়তা দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া চক্রের মূল হোতাসহ তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব। গতকাল বুধবার দিবাগত রাত ১টার দিকে র্যাব-২-এর একটি দল রাজধানী ও এর আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আজ বৃহস্পতিবার সাড়ে ১১টার দিকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন—মো. ইকবাল হোসেন (৪২), রমিজ মৃধা (৩০), মো. নজরুল ইসলাম (৫০) ও মো. মোদাচ্ছের হোসেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা প্রতারণায় নিজেদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে তথ্য দিয়েছেন। হিডেন স্পাই ওয়্যারলেস কিট ব্যবহার করে তাঁরা কার্যক্রম চালাতেন। কোনো একটি ঘরে বসে তাঁদের পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রশ্নের উত্তর বলে দিতেন। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে মোবাইল, ব্যাটারি, ইনভিজিবল ব্লুটুথ কিট, ভিআইপি স্মার্ট ডিভাইস, নগদ অর্থ, প্রথম ধাপের প্রাইমারি সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও সমাধান জব্দ করা হয়।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘বিদেশ থেকে আনা এ ডিজিটাল ডিভাইসগুলো মূলত দুটি অংশে বিভক্ত। ডিভাইসটির একটি অংশ ইয়ার পিস—এটি পরীক্ষার্থীদের কানের ভেতরে দেওয়া থাকতো এবং অটোমেটিক কল রিসিভ হওয়া সিম লাগানো অপর অংশটি শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ কায়দায় লুকিয়ে রাখা হতো। এরপর তাঁদের পরীক্ষার হলে প্রবেশ করানো হতো। পরে পরীক্ষার্থীরা নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ছবি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে ওই চক্রের কাছে পাঠাতো। প্রতারক চক্রটি প্রশ্নপত্রের উত্তর দেওয়ার জন্য আগে থেকেই মেধাবী শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে একটি টিম প্রস্তুত রাখতো। পরে ওই চক্রের সদস্যেরা পরীক্ষার হল থেকে পাঠানো প্রশ্নপত্রের উত্তর মেধাবী শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত টিমের মাধ্যমে খুঁজে বের করে চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থীদের বলে দিতো।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা প্রথমে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি নিয়োগ পরীক্ষা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতেন। পরে ওই নিয়োগ পরীক্ষা চলাকালে স্থান ও পরীক্ষার গার্ড সম্পর্কে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে। এ সময় চক্রের অন্য সদস্যেরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সরকারি-বেসরকারি চাকরি প্রত্যাশীদের খুঁজে বের করে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে পরীক্ষায় পাস ও চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তার মাধ্যমে প্রলোভন দেখাতেন। আগ্রহী পরীক্ষার্থীদের ডিজিটাল ডিভাইসগুলো দিয়ে এর ব্যবহার বিধি প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রাথমিকভাবে এক থেকে দুই দুই লাখ টাকা জামানত হিসেবে গ্রহণ করতেন। অবশিষ্ট টাকা চাকরি পাওয়ার পরে পরিশোধ করার শর্তে চুক্তি করতেন। এভাবে তাঁরা কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার আল মঈন জানান, প্রতারক চক্রটির মূল হোতা মো. ইকবাল হোসেন ২০০৮ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি নিজ এলাকায় শিক্ষকতা করার সময় ২০১৫ সালে একই এলাকার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী আলতাফ হোসেন নামক এক ব্যক্তির সাথে পরিচয়ের সূত্রে এই প্রতারণার বিষয়টি রপ্ত করেন। করোনা মহামারির সময় আলতাফ হোসেন মারা গেলে ইকবাল হোসেন এই প্রতারক চক্রটি পরিচালনা করা শুরু করেন। তাঁর বিরুদ্ধে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানায় একটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা ও বেশ কয়েকটি সাধারণ ডায়েরি রয়েছে।
খন্দকার আল মঈন আরও জানান, গ্রেপ্তার রমিজ এই প্রতারক চক্রের অন্যতম সহযোগী এবং একটি হত্যা মামলার পলাতক আসামি। পলাতক অবস্থায় ২০২০ সালে ইকবালের সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর।
অন্যদিকে, গ্রেপ্তার হওয়া নজরুল ১৯৯৪ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরিতে যোগদান করেন। নজরুল ও রমিজ পূর্বপরিচিত। নজরুল দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে সাধারণ চাকরি প্রার্থীদের ইকবাল ও রমিজের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতেন। এ ছাড়া বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার সময়, স্থান ও পরীক্ষায় গার্ড খুঁজে বের করার দায়িত্ব পালন করতেন।
গ্রেপ্তার হওয়া মোদাচ্ছের মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার সমাজসেবা কার্যালয় থেকে সমাজসেবাকর্মী হিসেবে ২০১৯ সালে অবসরে যান। তিনি ইকবালের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন।