গেরিলা থেকে মেয়র
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার শিবিরে আতঙ্ক ছিলেন এই গেরিলা যোদ্ধা। ঢাকায় তাঁর নেতৃত্বাধীন ইউনিট নিয়ে গেরিলা আক্রমণে তিনি গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন তথ্য অধিদপ্তর, নির্বাচন কমিশন ও বিমানবাহিনীর রিক্রুটিং অফিস। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এটিকে যুদ্ধের মনস্তাত্বিক বিজয় বলে উল্লেখ করেছিল।
সেই গেরিলা যোদ্ধা সবাইকে কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছেন চিরতরে। অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র, সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা আজ সোমবার বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যানসার সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
১৯৫২ সালের ১২ মে মুন্সীগঞ্জের সৈয়দপুরে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সাদেক হোসেন খোকা। পৈতৃকসূত্রে থাকতেন পুরান ঢাকার গোপীবাগে।
বর্ণাঢ্য এক রাজনৈতিক জীবন অর্জন করেছিলেন পুরান ঢাকার এই নেতা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় গেরিলা বাহিনীর যোদ্ধা থেকে হয়েছিলেন জননেতা, মন্ত্রী ও মেয়র। দীর্ঘ জীবনে ধাপে ধাপে যেন নিজেকে নিজেই ছাড়িয়ে গেছেন সাদেক হোসেন খোকা।
বাম রাজনীতির স্বর্ণযুগে ১৯৬৭ পূর্ব সময়ে ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা সদর দক্ষিণের সম্পাদক। পরে মওলানা ভাসানীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধপূর্ব সময়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদেও বড় ভূমিকা ছিল সাদেক হোসেন খোকার।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়েও দীর্ঘদিন বাম রাজনীতি করেছেন সাদেক হোসেন খোকা। পরে কাজী জাফরের পিপিপি পার্টি হয়ে ১৯৮৪ সালে যোগ দেন বিএনপিতে। ওই সময় নয়াবাজার নবাব ইউসুফ মার্কেটে বিএনপির কার্যালয় থেকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করে সাতদলীয় জোটের নেতৃত্ব দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ওই আন্দোলনে ঢাকা মহানগর সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের দায়িত্ব খোকাকে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯০ সালে ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে পুরান ঢাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার চেষ্টা হলেও তা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। এতে খোকা পুরান ঢাকাবাসীর আস্থা অর্জন করেন।
রাজনৈতিক জীবনে ১৯৯১ সালে বড় চমক দেখান খোকা। ওই বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৭ আসন (সূত্রাপুর-কোতোয়ালি) থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আলোচনায় আসেন। ওই সময় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে বিএনপি। খোকাকে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধী দল কঠোর আন্দোলন শুরু করলে ঢাকায় বিএনপি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ১৯৯৬ সালে খোকাকে মহানগর বিএনপির আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকার আটটি সংসদীয় আসনের মধ্যে সাতটিতে বিএনপি প্রার্থী পরাজিত হলেও একমাত্র খোকা নির্বাচিত হন।
পরে আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রায় পাঁচ বছর একক নেতৃত্ব দিয়ে খোকা বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতায় পরিণত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনেও বিএনপির হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন খোকা। দায়িত্ব পান মৎস্য ও পশুসম্পদমন্ত্রীর। ওই সময় পুরান ঢাকায় বিএনপির রাজনীতিতে নিজস্ব বলয় তৈরির পাশাপাশি প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ডে দলকে শক্তিশালী করার পেছনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা নয় বছর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এরই মধ্যে খোকাকে সভাপতি ও আবদুস সালামকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়। নতুন করে কমিটি গঠনের জন্য আবার ২০১১ সালে সাদেক হোসেন খোকাকে আহ্বায়ক ও আবদুস সালামকে সদস্য সচিব করে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালে তিনি দলের ভাইস চেয়ারম্যানের পদ পান।
ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে সাদেক হোসেন খোকার। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দায়িত্ব নেন ব্রাদার্স ইউনিয়নের। ছিলেন ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ও ফরাশগঞ্জ ক্লাবের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যানও। এ ছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন বহুদিন।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে রাজপথে সক্রিয় এই নেতা নির্যাতিত হয়েছেন অসংখ্যবার। কারাভোগ করেছেন ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময়। ওই বছরই মুক্তি পাওয়ার কিছুদিন পর ৩০টিরও বেশি মামলা মাথায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। সেখানে থাকা অবস্থায় ২০১৫ ও ২০১৮ সালে দুর্নীতির দুই মামলায় ১৩ ও ১০ বছরের সাজা হয় বিএনপির এই প্রভাবশালী নেতার।