গৃহকর্ত্রীকে নির্যাতন ও লুট : রেখার কথা বিশ্বাস করছে না পুলিশ
রাজধানীর মালিবাগে সত্তরোর্ধ্ব এক গৃহকর্ত্রীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের পর স্বর্ণালংকার ও টাকা লুট করেছিলেন গৃহকর্মী রেখা আক্তার। পরে ঠাকুরগাঁও থেকে পুলিশের জালে ধরা পড়েন তিনি।
ধরার পড়ার পর রেখা আক্তার দাবি করেন, স্বামীর নির্দেশে দোকান দেওয়ার টাকা জোগাতে ও বিদেশ যাওয়ার জন্য অর্থের প্রয়োজনে তিনি ওই বৃদ্ধাকে নির্যাতনের পর স্বর্ণালংকারসহ টাকা লুট করেছিলেন।
লুটের অর্থ ও স্বর্ণালংকার রেখা নিজের কাছে ছাড়াও আরো দুই স্থানে রেখেছিলেন। ঠাকুরগাঁও থেকে রেখাকে ঢাকায় নিয়ে আসার পর গতকাল রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় তাঁর বোনের বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে একটি এলইডি টিভি উদ্ধার করে শাহজাহানপুর থানা পুলিশ।
নির্যাতন ও লুটের ঘটনা ঘটে গত সোমবার। পরের দিন মঙ্গলবার শাহজাহানপুর থানায় একটি মামলা করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা শাহজাহানপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রেজাউল করিম। তিনি এনটিভি অনলাইনকে জানালেন, ‘তিনি (রেখা) দুই রকম তথ্য দিচ্ছেন। তাঁর কথা বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। রেখার এসব কথা কৌশলগত অবস্থানও হতে পারে। তবে কেন মারধর করা হলো, তার যথাযথ উত্তর এখনো দিচ্ছেন না রেখা। ফলে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে দ্রুতই।’
রেজাউল করিম আরো বলেন, ‘এ ঘটনায় রেখার স্বামী ফরহাদ হোসেনকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ফরহাদ আমাকে জানিয়েছেন, একটি দোকান করার জন্য তিনি রেখার কাছে টাকা দাবি করেছিলেন। রেখা ফরহাদের দ্বিতীয় স্ত্রী। তাঁর প্রথম স্ত্রী থাকেন রাজধানীর উত্তর বাসাবোর কালভার্ট রোড এলাকায়।’
তদন্ত কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘রেখা আগে সৌদি আরবে থাকতেন। সেখান থেকে ফিরে এসে বছর চারেক আগে ফরহাদকে বিয়ে করেন। তিনি পুনরায় সৌদি আরবে ফিরতে চান। এ প্রসঙ্গে রেখা আমাকে বলেছেন, তিনি আবারও সৌদি আরবে যেতে চান, আর এজন্য তাঁর অনেক টাকার দরকার। এদিকে স্বামীও টাকার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন বলে দাবি করে রেখা জানিয়েছেন, টাকা না দিলে তাঁর স্বামী প্রথম স্ত্রীর কাছে চলে যাবেন—এমন হুমকিও দিচ্ছিলেন। সব মিলিয়ে রেখা ছিনতাইয়ের সিদ্ধান্ত নেন।’
‘কিন্তু সত্তরোর্ধ্ব ওই গৃহকর্ত্রীকে এভাবে বিবস্ত্র করে মারধর করা হলো কেন—এমন প্রশ্নে রেখা আক্তার জানিয়েছেন, কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে ওই গৃহকর্ত্রী প্রথমে রেখাকে তাঁর লাঠি দিয়ে একটি বাড়ি মারেন। তারপর মূলত মারধরের সিদ্ধান্ত নেন,’ যোগ করেন রেজাউল করিম।
তবে রেজাউল জানান, এসব আপাতত বিশ্বাস করছেন না তিনি। কারণ, সিসি ক্যামেরার ভিডিও বলছে ভিন্ন কথা। সেবা করতে করতে মারধর শুরু করেন রেখা। রেজাউল বলেন, ‘আমি পুরো ভিডিওটি এখনো দেখতে পারিনি, আজ দেখব। তাহলে আরো কিছু বিষয় পরিষ্কার হবে। রেখা যা যা ছিনতাই করেছিলেন, তা তিনি নিজের কাছে রাখাসহ স্বামী ও বোনের কাছে রেখেছিলেন।’
মালিবাগের যে বাসায় এই ঘটনা ঘটেছে, ওই বাসায় নিচ তলার একটি টিনশেডে স্বামী ফরহাদের সঙ্গে রেখা থাকতেন বলে জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। রেজাউল বলেন, ‘৭ জানুয়ারি ওই টিনশেডের বাসা ছেড়ে দেন রেখা। তারপর থেকে তিনি একাই গৃহকর্ত্রীর বাসায় ছিলেন। এরপর তাঁর স্বামী ফরহাদ থাকা শুরু করেন প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে।’
গত বুধবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলা থেকে রেখাকে গ্রেপ্তার করা হয়। শাহজাহানপুর থানার এসআই রেজাউল করিম গতকাল বৃহস্পতিবার এনটিভি অনলাইনকে বলেছিলেন, ‘মামলার পর রেখাকে খুঁজতে থাকে পুলিশ। এর মধ্যে তাঁর স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হয়। রেখার অবস্থান জানার পর শাহজাহানপুর থানার যে দল ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁও গিয়ে রেখাকে গ্রেপ্তার করে, রেজাউল করিম সে দলের নেতৃত্বে ছিলেন।’
রেজাউল করিম বলেছিলেন, ‘গৃহকর্ত্রীকে নির্যাতন করে স্বর্ণসহ টাকা লুট করার পর রেখা প্রথমে তাঁর স্বামী ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে এক জোড়া কানের দুল আর একটি মোবাইলফোন রেখে আবার অন্য একটি স্থানে যান। সেখানেও কিছু জিনিসপত্র রাখেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। তারপর গত সোমবার বা মঙ্গলবারের দিকে নিজের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বড়পলাশবাড়ী ইউনিয়নের বেলসাড়া গ্রামে না গিয়ে তাঁর মামা কফিল উদ্দিনের বাড়িতে চলে যান।’
এসআই রেজাউল বলেন, ‘এ খবর জানতে পেরে আমরা বুধবার ঢাকা থেকে রওনা দেই। সেখানে পৌঁছানোর পর দিবাগত রাত ৩টার দিকে রেখার মামার বাড়িতে অভিযান চালাই। সেখান থেকে রেখাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের সময় রেখার কাছে থাকা ৪৯ হাজার ৭০০ টাকাসহ একটি গলার চেইন, চারটি স্বর্ণের চুড়ি, দুটি আংটি ও একটি নাকের নথ উদ্ধার করি।’
এর আগে রেখার স্বামী ফরহাদ হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয় জানিয়ে রেজাউল করিম বলেন, ‘স্বামীর দেওয়া তথ্যে ও প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে আমরা রেখাকে অনুসরণ করছিলাম। ফরহাদকে গ্রেপ্তারের সময় ওই বাসা থেকে লুট করা একটি মুঠোফোন ও কানের দুল উদ্ধার করি।’
গত সোমবার সকাল সোয়া ১০টার রাজধানীর মালিবাগের ফাঁকা বাসায় সত্তরোর্ধ্ব ওই গৃহকর্ত্রীকে নির্যাতন ও লুটপাট করেন গৃহকর্মী রেখা। পুরো দৃশ্য রেকর্ড হয় ঘরে থাকা সিসিটিভির ক্যামেরায়। ওই সিসিটিভির ফুটেজ প্রকাশ করে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টি ফোর। এর পরই ইন্টারনেটে ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যায়।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, বছর তিনেক ধরে কিডনিসহ নানা সমস্যায় ভোগা বৃদ্ধা শুয়ে আছেন বিছানায়। পরম যত্নে তাঁর সেবা করছেন গৃহকর্মী রেখা। এর পরই দেখা যায় রেখার ভয়ংকর রূপ। তিনি বৃদ্ধাকে বিবস্ত্র করে তাঁকে জোর করে বাথরুমে ঢোকান। শীতের সকালে বৃদ্ধার গায়ে ঢালা হয় ঠান্ডা পানি। কিন্তু ভেতরে বৃদ্ধাকে আটকাতে না পেরে বেরিয়ে আসে রেখার আসল চেহারা।
যে লাঠিতে ভর করে বৃদ্ধা চলাফেরা করতেন, সেই লাঠি দিয়েই তাঁকে মারতে শুরু করেন রেখা। একের পর এক আঘাতে বৃদ্ধা মাটিতে লুটিয়ে পড়লেও থামেননি রেখা। মাথায়ও আঘাত করেন। একপর্যায়ে হাতের কাছে যা পেয়েছেন, তা দিয়েই চালিয়েছেন নির্যাতন। আলমারির চাবির জন্য বুকের ওপর পা তুলে দেন রেখা। বঁটি হাতেও তেড়ে যান। একসময় অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করেন বৃদ্ধা। গলা থেকে চেইন খুলে নিজের গলায় পরে নেন রেখা। হাতের বালাও পরেন।
চাবি দিয়ে আলমারি খুলতে ব্যর্থ হন রেখা। তার পরই অসুস্থ বৃদ্ধাকে টেনে নিয়ে বাধ্য করেন আলমারি খুলে দিতে। ড্রয়ার খুলে স্বর্ণ, টাকা ও মোবাইল ফোন নিজের কব্জায় নেন রেখা। এরপর সবকিছু ব্যাগে ভরে বৃদ্ধাকে বাসায় তালা মেরে দেন। পরে বাসার গেট খুলে ব্যাগসহ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান তিনি। ব্যবসায়িক কাজে বৃদ্ধার ছেলে ঢাকার বাইরে গেলে এই ঘটনা ঘটান গৃহকর্মী রেখা।