‘গুজব দেশকে বিপদে ফেলতে পারে’
পুরো পৃথিবী স্তব্ধ করোনাভাইরাস আতঙ্কে। বৈশ্বিক মহামারির রূপ নেওয়া ভাইরাসটি প্রতিরোধের উপায় বের করতে মরিয়া সবাই। সুযোগ থাকলে যার যার অবস্থান থেকে একে অপরকে সতর্ক করছেন মানুষ। সামনাসামনি থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নানা পরামর্শ দিয়ে অনেকেই লিখছেন বা বলছেন, ‘বি সেইফ।’
এমন যখন পরিস্থিতি, তখন আমরা কি একে অন্যকে শুধুই সতর্ক করছি? সতর্ক করতে গিয়ে মনের অজান্তেই করোনাভীতি সৃষ্টি করছি না তো? কখনো আবার ভুল তথ্য দিয়ে গুজব ছড়াচ্ছি না তো? রটে যাওয়া ওই গুজবের অনৈতিক সুযোগ কাউকে নিতে সহযোগিতা করছি না তো?
প্রশ্নগুলো সাধারণ সচেতন মানুষের। এদিকে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) বলছে, ‘এখনই আমাদের সচেতন হতে হবে দেশ ও জাতির জন্য। গুজবে কান না দিয়ে স্বনামধন্য গণমাধ্যম ও আইইডিসিআরের প্রতি আস্থা রাখতে হবে দেশবাসীকে।’
গত কয়েক দিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে কিছু গুজব, যা নিয়ে জানার চেষ্টা করেছেন এই প্রতিবেদক।
থানকুনি পাতা করোনার প্রতিষেধক?
গুজবের প্রভাব নিয়ে কথা হয় অতন্দ্রিলা নিহার সঙ্গে। অতন্দ্রিলা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। তিনি বলেন, ‘তিন দিন আগে ফেসবুকে অন্তত তিনজন আমাকে থানকুনির পাতা সংগ্রহ করতে বলেছেন। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার একজন কথিত পীর নাকি স্বপ্নে পেয়েছেন, থানকুনি পাতা করোনারভাইরাসের শ্রেষ্ঠ প্রতিষেধক! আর গুজবপ্রিয় মানুষ তা ফেসবুকে ভাইরাল করলেন। এরপর দেখা গেল, কিছু মানুষ রাতের আঁধারে থানকুনির পাতা সংগ্রহ করতে মাঠে নেমেছেন।’
কবিরাজি ঠেকাবে করোনাভাইরাস?
অতন্দ্রিলা নিহা আরো বলেন, “জানা নেই, বোঝা নেই, থানকুনির পাতা সংগ্রহ শুরু। ভাবা যায়? এ শিক্ষিত সমাজে এসব! তবুও মানুষ এমন করছে। কেন করছে? করছে স্রেফ গুজবে কান দিয়ে আতঙ্কিত হয়ে। এই আতঙ্কে আবার কেউ কেউ লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছেন। দ্রবের দাম বেড়েছে, অবৈজ্ঞানিক ‘কবিরাজগিরি’ বেড়েছে। আমার বাড়ির পাশে একজন কবিরাজ আছে। তার তাবিজ পরলে নাকি আর করোনাভাইরাস হবে না! একটি তাবিজ একশ টাকা করে নিচ্ছে। অনেককেই তাবিজ নিচ্ছে গোপনে গোপনে। এটাকে পুঁজি করে বেড়েছে স্বার্থ-সিদ্ধির কারবারও। বাজার ঘুরে দেখুন, চালের দাম কেজিতে অন্তত ১৫ টাকা বেড়েছে।”
১০ মিনিটে করোনার জীবাণু নষ্ট?
এ বিষয় নিয়ে কথা হয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা নাজমুল হুদার সঙ্গে। তিনি বলেন, “কয়েক দিন আগে ইতালি থেকে আমারই এক আত্মীয় দেশে ফিরেছেন। সেদিন দেখা হলে তিনি আমাকে বললেন, ‘করোনাভাইরাসের জীবাণু হাতে লাগলেও ১০ মিনিট পর নষ্ট হয়ে যায়। আবার ২৫ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রায় বাঁচতে পারে না। বাংলাদেশে তাই এ ভাইরাস কিছু করতে পারবে না। আর আমার শরীরে জ্বর-কাশি কিছু ছিল না। সুতরাং চিন্তার কিছু নেই। কয়েক দিনের জন্য এসেছি, সব সময় বাড়িতে বসে থাকি কী করে?’ আমি বললাম, এ ধারণা কোথা থেকে জন্মাল? তিনি কয়েকবারই জানিয়েছেন, ফেসবুকে এসব তথ্য জেনেছেন। তাঁকে বললাম, এসব তথ্য সঠিক নয়। তিনি বিশ্বাসই করলেন না। সে ব্যক্তি এখন সন্দেহভাজন রোগী হিসেবে হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন। অথচ আগে আমার কথা বিশ্বাসই করেননি।”
গরম পানি দিয়ে গড়গড়ায় করোনা শেষ?
তনু আক্তার নামের এক ব্যাংকার বলেন, ‘ক্ষুদ্র জীবনপত্রে যা দেখেছি, এত আতঙ্ক আগে কখনো চোখেমুখে ভর করেনি। বারবার হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুই। যাতে (ভাইরাস) হাতে লেগে গেলেও মরে যায়। এ ছাড়া গরম পানি গলায় নিয়ে গড়গড়া করি। এতেও নাকি ভাইরাসটি আর কাজ করে না। সত্য হোক আর মিথ্যা হোক, একটু কষ্ট করে মেনে চললে যদি মানসিক স্বস্তি পাই, তাহলে ক্ষতি কী?’
তবে এসব গুজবের ব্যাপারে আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে সতর্ক থাকতে বলা হচ্ছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এ ধরনের তথ্য বা খবর নিশ্চিতভাবে গুজব। এখন পর্যন্ত এ সিদ্ধান্তে পৃথিবীর কোনো দেশ যেতে পারেনি যে, কত তাপমাত্রায় ভাইরাসটি আর কাজ করবে। গরম পানি খেলে বা গড়গড়া করলে এ রোগ সেরে যাবে, এমন কোনো কথা নয়। হাতে বা ত্বকে ভাইরাসটি মাত্র ১০ মিনিট টিকে থাকে, কথাটিও সত্য নয়। রাতে নাকি মানুষ থানকুনির পাতা খুঁজেছে লাইট মেরে মেরে। কী আজব! যেখানে পুরো পৃথিবী ভাইরাস মোকাবিলায় ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানে আমরা এসব গুজবে কান দিচ্ছি। এসব গুজব দেশকেও বিপদে ফেলতে পারে!’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, ‘এসব গুজব ছড়িয়ে একশ্রেণির মানুষ লাভবান হয়। ইউটিউবে টাকা কামানো যায়। কারণ, এসব সম্পর্কিত ভিডিও মানুষ দেখে খুব। আতঙ্ক তৈরি হয়। দেখবেন করোনায় অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে বলে অডিও ভাইরাল হচ্ছে। এগুলোর কিন্তু কোনো সত্যতা নেই। এগুলো থেকে আমাদের সতর্ক থাকা জরুরি। কিছুদিন আগে ইউনিসেফের দেওয়া তথ্য হিসেবে কিছু নির্দেশনা ভাইরাল হয়েছিল। সেগুলো নিয়ে কিন্তু ইউনিসেফই আবার প্রতিবাদ জানিয়েছে। এ রকম আরো অনেক গুজব ছড়াবে একটি মহল। তাদের এড়িয়ে চলা উচিত।’