খালেদা জিয়ার মুক্তিতে বিএনপিতে স্বস্তি, বহরে নেতা-কর্মীদের ভিড়
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল মঙ্গলবার ঘোষণা দেন, মানবিক কারণে সরকারের নির্বাহী আদেশে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই খবরে স্বস্তি প্রকাশ করে বিএনপি। স্বস্তি নেমে আসে নেতাকর্মীদের মাঝে। তখন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন কারাবন্দি খালেদা জিয়া।
আজ বুধবার দলের চেয়ারপারসনকে মুক্তি দেওয়া হবে এই খবরে সকাল থেকেই হাসপাতালের আশেপাশের এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। জড়ো হতে থাকেন গণমাধ্যমকর্মীরা। দুপুরের দিকে হাসপাতাল গেটে আরো সহস্রাধিক নেতাকর্মী জড়ো হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও বাড়তে থাকে।
ঠিক দুপুর আড়াইটার দিকে হাসপাতাল গেটে গিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশ জাতীয়বাদী তাঁতী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বিতীয় যুগ্ম আহবায়ক মনিরুজ্জামান মনির হাজির হন অন্তত ৩০জন নেতাকর্মী নিয়ে। এসেই তিনি খালেদা জিয়াকে নিয়ে নানা ধরনের স্লোগান দিতে থাকেন। স্লোগান দিতে দিতে তিনি বলেন, ‘এখন থেকে বিএনপির নেতাকর্মীরা আরো ঐকবদ্ধ হবে। বাংলাদেশকে স্বৈরাচারী সরকার থেকে মুক্ত করবে।’
সময় যত গড়াতে থাকে হাসপাতালের গেটে তত বেশি নেতাকর্মী জড়ো হতে থাকে। গণমাধ্যমকর্মীও ছিলেন অন্তত ১০০ জন। এক পর্যায়ে বিকেল তিনটার দিকে খালেদা জিয়ার নিত্যনৈমিত্তিক জিনিসপত্র নিচে নামানো হয়। এরপর পুলিশও প্রস্তুত হতে থাকে। কিন্তু সাধারণ মানুষকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাদেরকে কঠোর হতেও দেখা যায়নি। ওই সময় ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘এখানে আমরা স্রেফ লাঠি চার্জ করলেও তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠবে। এই আপনারাই লিখবেন।’
এই যখন পরিস্থিতি তখন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর বিএনপির (দক্ষিণ) সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেল কয়েকদফা নেতাকর্মী ও উৎসুক সাধারণ মানুষকে সরে যেতে অনুরোধ করে বলেন, ‘আপনারা না সরে গেলে আমাদের নেত্রী নামবেন না। আপনারা সরে যান।’ এরপরও কেউ সরছিলেন না। এক পর্যায়ে রেগে গিয়ে সোহেল নিচে নেমে আসেন। এসে কয়েকজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন কেবিন ভবনের গেট থেকে। তারপর পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক হয়। ওই সময় সাংবাদিকরা তাঁকে বলেন, ‘আপনি ছাড়া এই কাজ সম্ভব হত না!’
এই ঘটনার ঠিক ২৫ মিনিট পর অর্থাৎ সাড়ে তিনটার সময় আবারো নেতাকর্মীরা জটলা পাকাতে থাকেন। তখন ওই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা অনেকেই সেখানে ভিড় জমান। এরপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজেই হ্যান্ড মাইক নিয়ে বলতে থাকেন, ‘আপনারা সরে যান। এখনই নেত্রী বের হবেন। আপনারা সহযোগিতা করুন।’ কিন্তু তবুও সরছিল না উৎসুক মানুষ ও নেতাকর্মীরা। পরে মির্জা ফখরুল মাইক নিয়ে নিচে নেমে আসেন। হাত দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন অনেককে। এরপর সরে যান উৎসুক মানুষ।
এরপর কেটে যায় আরো ৪৫ মিনিট সময়। পুরো সময় জুড়ে ফটো সাংবাদিকরা ক্যামেরা তাক করে ছিলেন গেটের দিকে (যে গেট দিয়ে খালেদা জিয়া বের হন)। ঠিক ৪টা ১৫ মিনিটে খালেদা জিয়া বের হন হাসপাতাল থেকে। এর অন্তত পাঁচ মিনিট আগে তাঁকে কেবিন ব্লাকের ছয় তলা থেকে নিচে নামানো হয়। খালেদা জিয়া বের হচ্ছেন এই দৃশ্য দেখা মাত্রই গণমাধ্যমকর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়েন ওই সময়ের দৃশ্য ধারনে।
খালেদা জিয়া যখন বের হন তখন দেখা যায়, তিনি হুইলচেয়ারে বসে আছেন। হুইলচেয়ারটি ঠেলে নিয়ে যান কয়েকজন। করোনাভাইরাসের আতঙ্কে মুখে পরা ছিল আকাশি নীল রঙের মাস্ক। হাত ছিল হলুদ রঙের কাপড় দিয়ে ঢাকা।
এরপর পর্যাপ্ত নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি গাড়ির কাছে। অনেক আগে থেকেই খালেদা জিয়ার অপেক্ষায় ছিল ঢাকা-মেট্রো-ভ ১১-০৬৯২ নম্বরের একটি গাড়ি। এরপর ৪টা ২০ মিনিটে খালেদা জিয়া গাড়িতে ওঠেন। তবে ভবনের গেট থেকে গাড়িটি অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে হাসপাতালের প্রবেশদ্বার পর্যন্ত যেতে কমপক্ষে আরো ১৫ মিনিট সময় লাগে।
খালেদা জিয়া হাসপাতালের গেট দিয়ে বের হওয়ার আগে থেকে নেতাকর্মীরা একটি বড় মোটরসাইকেল বহর নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। আশেপাশে এলাকায় খালেদা জিয়াকে এক নজর দেখার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন অনেক মানুষ। এরপর ধীরেধীরে খালেদা জিয়ার বহরটি চলতে শুরু করে গুলশানের দিকে। খালেদা জিয়ার বহরের সামনে-পেছনে গণমাধ্যম ও ব্যক্তিগত অন্তত ৫০টি গাড়ি ছিল। পুরো বহরটি চলছিল ধীরে ধীরে। আর বহরটির সামনে ছিল নেতাকর্মীদের মিছিল।
বহরটির সঙ্গে সঙ্গে পায়ে হেঁটে রাজধানীর কারওয়ান বাজার পর্যন্ত আসেন রমনা বিভাগের ডিসি সাজ্জাদুর রহমানও। কারওয়ান বাজার এসে পুরো বহরটি থেমে যায় ভিড়ের কারণে। এদিকে নেতাকর্মীদের কোনো ভাবেই সরানো যাচ্ছিল না। কারওয়ান বাজার পর্যন্ত বহরটি আসতে সময় লাগে ২৮ মিনিট।
এরপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ওই সময় মিছিলে লাঠিচার্জ শুরু করে। এরপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। বহরটি গুলশানের দিকে চলতে থাকে দ্রুত গতিতে। এভাবে সোজা বহরটি গিয়ে থামে রাজধানীর গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজা’ ভবনে। এরপর সেখানে গিয়ে দেখা যায়, অনেক নেতাকর্মী জড়ো হয়েছেন। খালেদা জিয়াকে দেখে স্লোগান দিতে থাকেন অনেকেই। তারপর দীর্ঘ দুই বছর ১ মাস ১৭দিন পর ভবনটিতে প্রবেশ করেন সদ্য কারামুক্তি পাওয়া বেগম খালেদা জিয়া।