কিডনি গায়েবে নারীর মৃত্যু : বিএসএমএমইউতে মানবাধিকার কমিশনের তদন্তদল
একটি কিডনি ফেলে দেওয়ার সময় আরেকটি কিডনি গায়েব করে দেওয়ার ঘটনায় রওশন আরা নামের এক নারী মারা যান বলে পরিবারের অভিযোগ। নিহতের ছেলে রফিক শিকদার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের গিয়ে এই অভিযোগ জানান। ওই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে কমিশনের তদন্তকারীদল গিয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)।
আজ বুধবার সকালে তদন্তদলের প্রধান ও কমিশনের পরিচালক আল মাহমুদ ফায়জুল কবিরসহ তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল যায় বিএসএমএমইউতে।
তথ্য সংগ্রহ শেষে আল মাহমুদ ফায়জুল কবির বলেন, ‘রফিক শিকদার আমাদের কাছে জবানবন্দি ও উনার মায়ের প্যাথলজিক্যাল রিপোর্টগুলো দিয়েছেন। সেখান আমরা দেখেছি, অস্ত্রোপচারের আগে রওশন আরার দুটি কিডনির অস্তিত্ব ছিল। দেখা গেছে, ডান কিডনির ফাংশনাল অবস্থা ছিল ৮০ দশমিক এক ভাগ। আর বাঁ কিডনির অবস্থা ছিল ২০ দশমিক ৪ ভাগ।’
মৃত রওশন আরার ছেলে রফিক শিকদারের অভিযোগ, অস্ত্রোপচারের সময় হাসপাতালের চার চিকিৎসক তাঁর মায়ের একটি কিডনি ফেলে দেওয়ার পাশাপাশি আরেকটি কিডনিও গায়েব করে দেন। এতে রওশন আরা সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে মারা যান।
কিডনি গায়েবের ঘটনাটি ঘটে ২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। সেই নারীর ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দুই বছর পর নভেম্বরের শুরুর দিকে হাতে পেয়েছেন রফিক শিকদার। প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর গত ২৬ নভেম্বর রাতে চলচ্চিত্র পরিচালক মো. রফিক শিকদার বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয়েছে বিএসএমএমইউর ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুর রহমান দুলাল (৫৫), সহকারী অধ্যাপক মো. ফারুক হোসেন (৪৮), চিকিৎসক মো. মোস্তফা কামাল (৪৬) ও চিকিৎসক আল মামুনকে (৩৩)।
রফিক শিকদার গত ২৮ নভেম্বর এনটিভি অনলাইনের কাছে দাবি করেন, ২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর হাসপাতালটির ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল, সহকারী অধ্যাপক ডা. ফারুক হোসেন, মেডিকেল অফিসার আল মামুন ও তৎকালীন রেসিডেন্স (শিক্ষার্থী) ডা. মোস্তফা কামাল মিলে রওশন আরার বাঁ পাশের কিডনি অপসারণ করতে অস্ত্রোপচার করেন। কথা ছিল বাঁ পাশের কিডনি ফেলে দেবেন। বাঁ পাশের কিডনি ফেলার সঙ্গে সঙ্গে তারা ডান পাশের কিডনিটাও গায়েব করে দেন।
রফিক শিকদারের দাবি, ‘এসব ঘটনা নিয়ে একের পর এক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর ওই বছরের ১ অক্টোবর অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতিতে গিয়ে আমার সঙ্গে একটি চুক্তিনামা করেন। তিনি আমার মায়ের ডান পাশের কিডনি অপসারণের দায় স্বীকার করে নেন। এবং তিনি বিনামূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করে দেবেন বলেও আমাকে জানান। কিন্তু এই বিষয়ে পরে তিনি আর কখনো খোঁজখবর নেননি।’
যদিও সে সময় নিজের খালার কাছ থেকে কিডনি সংগ্রহ করেছিলেন দাবি করে রফিক শিকদার বলেন, ‘অপারেশনের পর মায়ের শরীরে দুটি কিডনিই না থাকায় তাঁর শরীর বিকল হতে শুরু করে। ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর বিএসএমএমইউতে আমার মা মারা যান। এরপর শাহবাগ থানায় আমি একাধিকবার মামলা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মামলা নেওয়া হয়নি। বলা হয়েছিল, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন না পেলে মামলা নেওয়া হবে না। কিন্তু দুই বছরেও আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ থেকে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাইনি। নানা সময়ে ওই বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ আমাকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে সময়ক্ষেপণ করিয়েছেন। সম্প্রতি আমি তাঁর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানালে তিনি চলতি মাসের শুরুর দিকে শাহবাগ থানায় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাঠান।’
‘ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমার মায়ের শরীরে কোনো কিডনি ছিল না। বিষয়টি প্রমাণিত। রিপোর্ট পাওয়ার পর আমি শাহবাগ থানায় মামলা করতে গেলে প্রথমে থানা কর্তৃপক্ষ মামলা নিতে অস্বীকার করে। পরবর্তীতে অনেক চেষ্টা করে মামলা দায়ের করেছি’, যোগ করেন রফিক শিকদার।
এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুন অর রশিদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমি থানায় যোগদান করেছি মাত্র তিন মাস। আগে কেন মামলা নেওয়া হয়নি, তা আমি জানি না। আমি মামলা নিয়েছি। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। তবে এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।’
অভিযোগের বিষয়ে অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুর রহমান দুলাল ও একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. ফারুক হোসেনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের দেরি প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ বিকেলে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা বোধহয় রিপোর্টটি আরো আগেই হাসপাতালে জমা দিয়েছি। তারপর পুলিশের কাছে দিয়েছি। ভুক্তভোগীর রিপোর্টটি পেতে বোধহয় সেজন্য দেরি হয়েছে।’
এ সময় সোহেল মাহমুদ আরো জানান, এই ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের ব্যাপারে কেউ তাঁকে মামলার কোনো হুমকি দেননি।
কিডনি গায়েবের ঘটনা যখন ঘটেছিল তখন ইউরোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন অধ্যাপক ডা. মো. সাজিদ হাসান। তিনি বলেন, ‘আমার যতটুকু মনে পড়ে ঘটনার সময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি করেছিল। কারণ, ঘটনাটি হাসপাতালেই বেশ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। তবে তদন্ত প্রতিবেদনে কী বলা হয়েছিল, তা আমি জানি না। তবে এ রকম একটি ঘটনার ময়নাতদন্ত করতে দুই বছর বা তার বেশি সময় লাগার ঘটনা স্বাভাবিক নয়।’
বর্তমানে ইউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ কে এম খুরশিদ আলম। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘যেহেতু একটি মামলা হয়েছে সেহেতু আপাতত বিষয়টি নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। এই বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। তারা একটি তদন্ত প্রতিবেদনও দিয়েছিলেন। ওই ঘটনার পর আর কোনো কিছু শুনিনি। আমি ভেবেছিলাম সব বোধহয় ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসার পর দেখলাম, আবার এসব নিয়ে কথা শুরু হয়েছে। যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাঁরা এখনো দায়িত্ব পালন করছেন।’