করোনার নমুনা পরীক্ষা কেন কম?
টানা তিনদিন ধরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১০০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন। অথচ গত ৬ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ছিল ৬৬ জন। ওইদিন নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছিল সাত হাজার ২১৩ জন। করোনায় শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা—দুটোই ছিল ততদিনের রেকর্ড।
ঠিক ১০ দিন পর অর্থাৎ গত শুক্রবার মৃত্যুর সংখ্যা গিয়ে পৌঁছে ১০১ জনে। সেদিন চার হাজার ৪১৭ জন আক্রান্ত হয় ভাইরাসটিতে। মৃত্যুর এই ধারাবাহিকতা এর পরের দুদিন ধরেই অব্যাহত আছে। তবে দুদিনে আক্রান্তের সংখ্যা আরও কমে গেছে। তবে শনাক্তের হার প্রায় কাছাকাছি ছিল।
শনিবারও করোনায় মারা গেছেন ১০১ জন। আক্রান্ত হয় তিন হাজার ৪৭৩ জন। রোববার ১০২ জনের মৃত্যু হয় ও নতুন শনাক্ত হয় তিন হাজার ৬৯৮ জন।
দিন দিন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লেও কমছে শনাক্তের সংখ্যা। কমছে করোনার নমুনা পরীক্ষা করার হারও। হঠাৎ কেন নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কমছে, জনমনে দেখা দিয়েছে এই প্রশ্ন।
নমুনা পরীক্ষা ও শনাক্তের সংখ্যা কমার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, লকডাউনের মধ্যে মানুষ ঘর থেকে বের হতে না পারার ফলে নমুনা পরীক্ষা করার সংখ্যাও কমেছে। তবে কিট সংকটের কারণে নমুনা পরীক্ষা সংখ্যা কমছে না বলে অধিদপ্তরটির কর্মকর্তাদের দাবি।
যদিও এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাতে কী পরিমাণ নমুনা পরীক্ষার কিট মজুত রয়েছে তা জানাতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।
তবে করোনার নমুনা পরীক্ষা করতে যাওয়া ভুক্তভোগীরা বলছেন অন্য কথা। তাদের দাবি, হাসপাতাল থেকে কিট সংকটের কথা বলা হচ্ছে। নমুনা পরীক্ষা করতে অন্তত আটদিন সময় লাগবে বলেও হাসপাতাল থেকে তাদেরকে জানানো হয়। এ নিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। দ্রুত পরীক্ষার ফলাফল না পাওয়ায় অন্য শারীরিক জটিলতার বিষয়ে নিতে পারছেন না চিকিৎকের পরামর্শ।
কিট সংকটের অভিযোগ
গত ৮ এপ্রিল শামীমা আক্তার নামের তরুণী তাঁর ৫৪ বছর বয়সী মা রাশিদা বেগমকে নিয়ে গিয়েছিলেন খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গিয়ে করোনার নুমনাসহ আরও কয়েক ধরনের নমুনা পরীক্ষা করতে দেন। পরের দিন অন্য সব রিপোর্ট হাতে পেলেও পাননি করোনার নমুনা পরীক্ষার ফলাফল। পরে হাসপাতালে যোগাযোগ করা হলে কর্তৃপক্ষ শামীমাকে জানায়, হাসপাতালে ভর্তি না হলে অন্তত আটদিন লাগবে রিপোর্ট পেতে। এ কথা শুনে চমকে উঠেন শামীমা। কারণ, ততক্ষণে চিকিৎসক জানিয়ে দিয়েছেন; করোনার রিপোর্ট না পেলে অন্য চিকিৎসা করতে পারবেন না।
শামীমা আক্তার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘কোনো উপায় না দেখে ১০ এপ্রিল মাকে ভর্তি করাই খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ভর্তির পর আমাদেরকে রাখা হয় হাসপাতালের ইয়েলো জোনের একটি কক্ষে। ওই কক্ষে মোট আটজন ভর্তি ছিলেন। যারা সবাই করোনার নমুনা পরীক্ষা করতে দিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। মানে, ওই কক্ষে সবাই সন্দেহভাজন রোগী ভর্তি ছিলেন। কিন্তু রাতে ঘটে এক অদ্ভূত ঘটনা। আমাদের ওই কক্ষে একজন নারী রোগীকে রাখা হয়, যার করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসে। আমাদের বেডের পাশে ওই রোগীকে রাখা হয়। সারারাত ভয়ে ঘুম আসেনি। মাকে নিয়ে খুব খারাপ লাগছিল।’
শামীমা আরও বলেন, ‘যাই হোক, আমাদের পুনরায় করোনার নমুনা নেওয়া হয়। তারও দুদিন পরে রিপোর্ট হাতে আসে। কিন্তু এই রিপোর্ট হাতে পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। মানে, হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় যোগাযোগ করে রিপোর্ট পেতে হয়েছিল। অন্য যারা ভর্তি ছিলেন, তাঁরাও তিন-চারদিন পরে রিপোর্ট পেয়েছিলেন। দফায় দফায় হাসপাতালে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা বারবার বলছিলেন, নতুন পরীক্ষার জন্য জট লেগে গেছে। কিট সংকটের কথা বলা হচ্ছিল বারবার।’
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যে নমুনা পরীক্ষা করা হয়, তার দায়িত্বে আছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। কিট সংকটের ব্যাপারে জানতে চাইলে হাসপাতালের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আব্দুল আহাদ বলেন, ‘আমাদের কিছু কিট সংকট যাচ্ছে। এই সংকটের কারণে অনেক নমুনা পরীক্ষায় জট লেগে গেছে। তবে দ্রুতই ঠিক হয়ে যাবে বলে আমরা আশা করছি।’
‘লকডাউনে পরীক্ষা কমেছে, অ্যান্টিজেন্টের কথা ভাবছি’
হঠাৎ কম শনাক্ত ও নমুনা পরীক্ষার ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘যখন থেকে সরকার লকডাউন শুরু করে তখন থেকেই করোনার নমুনা পরীক্ষা করা কমে গেছে। এর কারণ হচ্ছে, মানুষ ঘর থেকে বের হতে চায় না অথবা পারে না। আর আমাদের সেরকমভাবে কিট সংকট না থাকলেও আমরা ভাবছি, অ্যান্টিজেন্ট কিট দিয়ে করোনা পরীক্ষা করানোর। কারণ, অ্যান্টিজেন্টের দাম কম। এ ছাড়া আরটিপিসিআর কিটের দাম অনেক বেশি। আমার মনে হয়, সব স্থানে অ্যান্টিজেন্ট টেস্ট বাধ্যতামূলক করা উচিত। প্রয়োজনবোধে আরটিপিসিআরে করা যাবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে আরটিপিসিআরে টেস্ট করানোর কারণে এখন আর মানুষ অ্যান্টিজেন্ট দিয়ে করাতে চায় না।’
ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘করোনা পরীক্ষার জন্য যে কিটের প্রয়োজন, তা দ্রুতই পেয়ে যাব আমরা। কারণ, আমাদের কিট কেনা আছে। এখন সেভাবে কিটের অভাববোধ করছি না। কিটের অভাব থাকলে ৩৪ হাজার নমুনা পর্যন্ত একদিনে পরীক্ষা করলাম কীভাবে?’ তবে দেশে কী পরিমাণ কিট মজুদ আছে তা জানাতে পারেননি তিনি।
দৈনিক প্রায় ৩০ হাজার পরীক্ষা
গত ১ এপ্রিল থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই সময়ে গড়ে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
এর মধ্যে ১ এপ্রিল দেশে করোনায় আক্রান্ত হয় ছয় হাজার ৪৬৯ জন, আর করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল ২৮ হাজার ১৯৮ জন। ২ এপ্রিল আক্রান্ত হয় ছয় হাজার ৮৩০ জন ও নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল ২৯ হাজার ৩৩৯ জনের, ৩ এপ্রিল আক্রান্ত হয় পাঁচ হাজার ৬৮৩ জনের ও নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল ২৪ হাজার ৫৪৮ জনের, ৪ এপ্রিল আক্রান্ত হয় সাত হাজার ৮৭ জন ও নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল ৩০ হাজার ৭২৪ জনের, ৫ এপ্রিল আক্রান্ত হয় সাত হাজার ৭৫ জনের ও নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল ৩০ হাজার ২৩৯ জনের, ৬ এপ্রিল আক্রান্ত হয় সাত হাজার ২১৩ জনের ও নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৩১১ জনের, ৭ এপ্রিল আক্রান্ত হয় সাত হাজার ৬২৬ জনের ও নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৬৩০ জনের, ৮ এপ্রিল আক্রান্ত হয় ছয় হাজার ৮৫৪ জনের ও নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল ৩৩ হাজার ১৯৩ জনের, ৯ এপ্রিল আক্রান্ত হয় সাত হাজার ৪৬২ জনের ও নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল ৩১ হাজার ৬৫৪ জনের, ১০ এপ্রিল আক্রান্ত হয় পাঁচ হাজার ৩৪৩ জনের ও নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল ২৬ হাজার ৭৭ জনের, ১১ এপ্রিল আক্রান্ত হয় পাঁচ হাজার ৮১৯ জনের ও নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল ২৯ হাজার ৩৭৬ জনের, ১২ এপ্রিল আক্রান্ত হয় সাত হাজার ২০১ জনের ও নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৬৯৮ জনের, ১৩ এপ্রিল আক্রান্ত হয় ছয় হাজার ২৮ জন ও নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল ৩২ হাজার ৯৫৫ জনের।
লকডাউন শুরুর দিনে ৩০ হাজার থেকে ১৯ হাজারে
করোনার প্রাদুর্ভাব রোধে গত ১৪ এপ্রিল থেকে সারা দেশে আটদিনের জন্য কঠোর বিধিনিষেধ জারি করে সরকার। যার কারণে সারা দেশে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তবে রাজধানীতে জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়ার জন্য মুভমেন্ট পাস চালু করে পুলিশ। এই সময়ে যারা বিনা কারণে বাইরে বেরিয়েছেন তাদের অনেককেই জরিমানার মুখে পরতে হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১৪ এপ্রিল আক্রান্ত হয় পাঁচ হাজার ১৮৫ ও নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল ১৯ হাজার ৮২৫ জন, ১৫ এপ্রিল আক্রান্ত হয় চার হাজার ১৯২ জন ও নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল ১৯ হাজার ৯৫৯ জনের, ১৬ এপ্রিল আক্রান্ত হয় চার হাজার ৪১৭ জন ও নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল ১৮ হাজার ৯০৬ জনের, ১৭ এপ্রিল আক্রান্ত হয় তিন হাজার ৪৭৩ জন ও নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল ১৬ হাজার ১৮৫ জনের এবং সবশেষ রোববার অর্থাৎ ১৮ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয় তিন হাজার ৬৯৮ জন ও নমুনা পরীক্ষা করা হয় ১৯ হাজার ৪০৪ জনের।
দেশে গত বছরের ৮ মার্চ করোনায় সংক্রমিত প্রথম রোগী শনাক্তের তথ্য জানায় সরকার। শুরুর দিকে পরীক্ষা কম ছিল, যে কারণে শনাক্তের হারও কম ছিল। পরে পরীক্ষা বাড়ানো হলে শনাক্তের হারও বাড়তে থাকে। মে মাসের শেষ সপ্তাহ বা সংক্রমণের ১২তম সপ্তাহ (২৪ থেকে ৩০ মে) থেকে পরীক্ষার তুলনায় সংক্রমণ শনাক্তের হার ২০ শতাংশের ওপরে চলে যায়।
সংক্রমণের ২৪তম সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে শনাক্তের হার ২০ শতাংশের বেশি ছিল। শুরু থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সপ্তাহওয়ারি হিসাবে দেশে রোগী শনাক্তের হার সবচেয়ে বেশি ছিল ২২তম সপ্তাহে (২ থেকে ৮ আগস্ট) ২৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
সংক্রমণের ২৩তম সপ্তাহ থেকে পাঁচ সপ্তাহ ধরে শনাক্তের হার আগের সপ্তাহের চেয়ে কমতে দেখা গেছে। সেখান থেকে কমতে কমতে এই হার চলতি বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিন শতাংশের নিচে নেমে আসে। তারপর থেকে পুনরায় করোনা শনাক্তের হার বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে মৃত্যুও।