‘কমেছে মামলা, বাড়ছে নিষ্পত্তি’
জরিনা বেগম (২৮)। স্বামী মোতালেবের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ঢাকার আদালতে একটি যৌতুক আইনের মামলা করেন। সেই মামলায় আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে, স্বামী মোতালেব গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আটক থাকেন। পরে আপসের কথা বলে স্বামী মোতালেব আদালত থেকে জামিন লাভ করেন। জামিনের পর দুজনই আদালতে হাজিরা দিতে থাকেন। মামলার পর তাদের মধ্যে সম্পর্কের দূরত্ব বাড়তে থাকে।
জরিনা মামলার খরচ মেটাতে গিয়ে হিমশিম খান। একপর্যায়ে তিনি মামলা আর চালাবেন না বলে মনস্থির করেন। এরই মধ্যে মামলাটি ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট-৯ নম্বর আদালতে বিচারের জন্য বদলি হয়ে আসে। বিচারক নিজ উদ্যোগে তাদের মধ্যে আপসের প্রস্তাব দেন। সেই আপসের প্রস্তাবের পর জরিনাকে তাঁর স্বামী ঘরে তুল নেন। তাঁদের সংসার আবারও নতুন করে জোড়া লাগে।
জরিনা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য না হওয়ায় যৌতুকের মামলা করেছিলাম। কিন্তু মামলা করার পর আদালতে আসা-যাওয়া ও উকিলের খরচ দিতে পারছিলাম না। তখনই বিচারক উভয়পক্ষকে আপস করিয়ে দেন। আমি আমার সংসার ফিরে পেয়েছি।’
একইভাবে হারুন শিকদার ও মমিন শিকদার নামে দুই ভাইয়ের মধ্যে মামলা চলছিল ঢাকার আরেকটি আদালতে। দুই ভাইয়ের মধ্যে আর্থিক লেনদেন নিয়ে মামলা। আদালত তাঁদের মধ্যেও আপস করে মামলা নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন। এভাবেই ঢাকার আদালতে মামলা নিষ্পত্তির হার অনেক বেড়েছে।
আরেক ভুক্তভোগী মমিন শিকদার বলেন, ‘ভুল বোঝাবুঝি থেকে আদালতে প্রতারণার মামলা করেছিলাম। মামলা দায়েরের পরে অনেক বছর হাজিরা দিয়েছি। কিন্তু ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ২০-এর বিচারক ইলিয়াস মিয়ার আদালতে আসার পরে বিচারক দুজনের মধ্যে আপসের প্রস্তাব দেন। আর আমরা উভয়ে আপসের ভিত্তিতে মামলা থেকে রেহাই পাই।’
অন্যদিকে নাজমুল হোসেন নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌতুক নিরোধ আইনের ৪ ধারায় মামলা করেন তাঁর স্ত্রী হুমায়রা। সেই মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আটক ছিলেন। হুমায়রার আগে একটি বিয়ে হয়েছিল, সেটি তিনি গোপন করেছিলেন। নাজমুল বিষয়টি জানতে পারলে সংসারে অশান্তি তৈরি হয়। এরপরই হুমায়রা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নাজমুলের বিরুদ্ধে যৌতুকের মামলার ঠুকে দেন। একপর্যায়ে বিচারক শহিদুল ইসলাম মামলাটি বাদীর অনুপস্থিতে খারিজের আদেশ দেন। আর এতে নাজমুল হোসেন মামলা থেকে রেহাই পান।
নাজমুল এ বিষয়ে বলেন, স্ত্রীর আগে একটি বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু সেটি গোপন করেছিল। আমার পরিবার তা জানার পরে, মনোমালিন্য শুরু হয়। পরে আমাকে যৌতুক নিরোধ আইনের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। আমি জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর ৭ নম্বর আদালতে প্রতিনিয়ত হাজিরা দেই। কিন্তু বাদী আদালতে না আসায় বিচারক মামলাটি খারিজ করে দেন। এতে আমার অর্থ, সময় বেঁচে গেছে। আদালতে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির কারণে জট কমে যাবে বলে জানান তিনি।
এনটিভি অনলাইনের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিগত এক বছরে ঢাকার নিম্ন আদালতে ৫০ ভাগের উপর মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। আর নতুন করে আদালতে মামলা দায়েরের পরিমাণও কমে যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকার আদালতে এখন বেশিরভাগই চেক প্রতারণার মামলা হচ্ছে। তবে আগে যৌতুকের মামলা দায়ের করা হলেও এখন মিথ্যা মামলায় বাদীর সাজা হতে পারে, তাই অনেকে যৌতুকের মামলা করছে না। এ ছাড়া সিএমএম আদালতের ৬ নম্বর আদালত, ৭ নম্বর আদালত, ১০ নম্বর আদালত, ১৯ নম্বর আদালত, ২০ নম্বর আদালত ও ২১ নম্বর আদালতে ৭০ ভাগের উপর মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।
এ দিকে ঢাকার সিএমএমের বিচারক রাজেশ চৌধুরীর ৯ নম্বর আদালতে গিয়ে দেখা গেছে, আদালতের ৭০ ভাগ মামলা এ বছরেই নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। গত এক বছরে মামলা দায়ের হয়েছে ৯০০টি। আর নিষ্পত্তি হয়েছে ৫০০টি। আর এ নিষ্পত্তির বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা।
তবে একদিকে নালিশি নিষ্পত্তির হার বাড়লেও মাদক মামলা সেই হারে নিষ্পত্তি হচ্ছে না। মাদকের মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সাক্ষী না আসাকে দায়ী করছেন আদালত সংশ্লিষ্টরা ।
মাদকের মামলায় ২০১৫ সালে গ্রেপ্তার হন নিজাম। ১৫ দিন জেল খেটে তিনি জামিনে মুক্তি পান। পরে মামলাটি ঢাকার মেট্রোপলিটন ২৩ নম্বর আদালতে বদলি হয়ে আসে। পাঁচ বছরেও সেই মামলায় কোনো সাক্ষী না আসায় মামলার কার্যক্রম স্থবির হয়ে রয়েছে। আর এ মামলা কবে নিষ্পত্তি হবে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই।
এ বিষয়ে নিজাম বলেন, ‘পুলিশের এক সোর্সের সঙ্গে তর্ক-বির্তকের জের ধরে সাতটি ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার দেখিয়ে আমাকে আদালতে চালান দেওয়া হয়। পরে জামিনে মুক্তি পাই। দীর্ঘ পাঁচ বছরেও মামলার একজন সাক্ষীও আসেননি। প্রতিনিয়ত আদালতে হাজিরা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। কবে রেহাই বা মুক্তি পাব, তা জানি না। আদালতে অন্যান্য মামলার মতো মাদক মামলায় পরিস্থিতি বিবেচনা করে সাক্ষীদের দ্রুত নিয়ে এসে নিষ্পত্তি করলে অনেকে লাভবান হবে।’
ঢাকার মেট্রোপলিটন আদালতের আইনজীবী মাহফুজুর রহমান অনেক প্রতারণা মামলায় বাদীপক্ষে লড়েছেন। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আদালতে মামলা করার পরে বিচারক উভয়পক্ষের মধ্যে আপস করে মামলা নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন। যা ছিল কল্পনার অতীত।’
আইনজীবী মাহফুজুর রহমান বলেন, আদালতে মামলার অনেক জট। প্রতিনিয়ত মামলা বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি মামলায় রায় হতে পাঁচ বছরের উপর লেগে যায়। এতে বাদী ও আসামির সমান অর্থ ব্যয় ও সময় নষ্ট হয়। এ ছাড়া দীর্ঘদিন মামলা বিচারাধীন থাকলে দুই পক্ষের মধ্যে অনীহা কাজ করে। কিন্তু মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ৯ নম্বর আদালতে মামলাটি আনায় খুব দ্রুত সময়ে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। তিনি বলেন, দেশের সব কয়টি আদালতে যদি এভাবে মামলা নিষ্পত্তি হতো তাহলে মামলার জট কমে যেত।
এ বিষয়ে চিফ জুডিশিয়াল আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবির বাবুল এনটিভি অনলাইনকে বলেন, আদালতে আপসের ভিত্তিতে মামলা নিষ্পত্তি করা গেলে অনেক বিচারপ্রার্থী হয়রানি থেকে মুক্তি পাবেন। তিনি বলেন, ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতেও মামলা আপসের ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করেন বিচারকরা। যদি আপস না হয় তাহলে আইন অনুযায়ী মামলার বিচার করা হয়।
বিডিআর বিদ্রোহ মামলার আইনজীবী ও সাবেক বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মনজুর আলম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ফৌজদারি মামলাগুলোর বেশিরভাগ ধারাই আপসযোগ্য। এসব মামলাই আদালতে বেশি দায়ের করা হয়। আদালত যদি আপসযোগ্য ধারার ক্ষেত্রে আপসের উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাহলে আদালতে মামলার জট খুব সহজে কমে যাবে। এ ক্ষেত্রে বিচারকদের আপস করানোর জন্য আরো বেশি আগ্রহী হয়ে উঠতে হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান খান রচি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, আপসের ভিত্তিতে আদালতে মামলা নিষ্পত্তি খুব ভালো দিক। এতে বিচারপ্রার্থীরা অনেক উপকৃত হবেন। পাশাপাশি সবাই আদালতের প্রতি আস্থা পাবেন। তিনি বলেন, ঢাকার সিএমএম আদালতের মতো দেশের সব আদালতের বিচারকরা যদি এভাবে আপসের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি করেন তাহলে মামলা জট খুব দ্রুত কমে যাবে।