কন্ডাক্টর থেকে বিপুল সম্পদের মালিক শাহীরুল গ্রেপ্তার
রাজধানী থেকে শাহীরুল ইসলাম সিকদার নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, তিনি প্রতারণাকে ‘শিল্পের পর্যায়ে’ নিয়ে গেছেন। নানা ছলে ২০০৩ সাল থেকে প্রতারণার মাধ্যমে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। প্রতারণার অভিযোগে গতকাল শুক্রবার সকালে রাজধানীর রামপুরা বনশ্রী এলাকায় অভিযান চালিয়ে শাহীরুলকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আজ শনিবার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাব-৪-এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক।
সংবাদ সম্মেলনে মোজাম্মেল হক জানান, শাহীরুল ইসলাম সিকদার এইচএসসি পাসের পর একটি বাস কোম্পানিতে কন্ডাক্টর হিসেবে চাকরি শুরু করেন। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৩ পর্যন্ত এই চাকরি করেন। পরবর্তীতে ‘সিকিউরিটি গার্ড’ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এভাবে চাকরির নামে হাতিয়ে নেন বিপুল অর্থ। পরবর্তীতে শুরু করেন ফ্ল্যাট ও জমির ব্যবসা। ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে টাকা নিলেও ফ্ল্যাট কিংবা জমি বুঝিয়ে দেননি তিনি।
মোজাম্মেল হক বলেন, ‘কেউ টাকা ফেরত চাইলে দিতেন হুমকি। সেজন্য নিজের টেবিলে সব সময় অস্ত্র রাখতেন। এসব থেকে বাঁচতে বা প্রতারণা করতে নিজেকে কখনও সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আবার মানবাধিকার সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান পরিচয় দিতেন। প্রতারণা করতে নামিদামি ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে তা বাঁধিয়ে রাখতেন। এখন পর্যন্ত শাহীরুলের ৫০ কোটি টাকার হিসাব পাওয়া গেছে। এগুলো শুধু জমি, বাড়ি ও ফ্ল্যাটের দাম। তবে, তার ব্যাংকে কত টাকা বা আরও কত সম্পদ আছে, তা জানা যায়নি। তবে, আমরা জানার চেষ্টা করছি।’
র্যাব বলছে, শাহীরুলের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড গার্ড সার্ভিসেস লি, হোমল্যান্ড ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ, মানবাধিকার সংস্থা, শাহীরুল অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট কো. লিমিটেড, হোমল্যান্ড হাউজিং, হোমল্যান্ড বেভারেজ অ্যান্ড অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, মাদারল্যান্ড সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড, শাহীরুল ইসলাম বাংলাদেশ আউট সোর্সিং অ্যান্ড পাওয়ার সাপ্লাইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন।
র্যাব-৪ এর অধিনায়ক বলেন, শাহীরুল ইসলামের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী আমাদের কাছে অভিযোগ দেয়। তাদের অভিযোগের পর র্যাবের গোয়েন্দারা ছায়াতদন্ত শুরু করে।
অস্ত্রগুলো কোথায় থেকে কেনা হয়েছে বা সংগ্রহ করা হয়েছে জানতে চাইলে র্যাব-৪ এর অধিনায়ক বলেন, ‘উনি বলেছেন, সবগুলোর লাইসেন্স রয়েছে। কিন্তু কোনোটারই লাইসেন্স দেখাতে পারেননি।’
র্যাব জানায়, গ্রেপ্তারের সময় শাহীরুলের কাছ থেকে তিনটি বিদেশি পিস্তল, একটি শটগান, একটি এয়ারগান, একটি এয়ার রাইফেল, ২৩৭টি গুলি, পাঁচটি ম্যাগাজিন, পাঁচটি খালি খোসা, ২২টি কার্তুজ, চারটি চাকু, তিনটি ডামি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে।
এ ছাড়া হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড গার্ড সার্ভিস লিমিটেডের চাকরির আবেদন ফরম, চুক্তিপত্র, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই, ব্যানার, প্যাড, স্ট্যাম্প, ল্যাপটপ, গোপন ক্যামেরা, পাসপোর্ট, ভিজিটিং কার্ড, আইডি কার্ড, নেমপ্লেট, বিভিন্ন নামীদামী ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা ছবি, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট, মানি রিসিভ বই, বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম কার্ড, মোবাইল ফোন উদ্ধার করে র্যাব।
শাহিরুলের উত্থান যেভাবে
শাহীরুল ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সৌখিন পরিবহণে কাজ করেছেন। এরপর শুরু করেন প্রতারণা। ২০০৩ সালে সিকিউরিটি গার্ড সরবরাহ প্রতিষ্ঠান চালু করেন। এরপর হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সার্ভিস লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠান খুলেন। অল্প সময়ে বিপুল টাকার লোভে ২০১৪ সালে রামপুরায় ‘হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড গার্ড সার্ভিস লিমিটেড’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান খুলে শুরু করেন অর্থ আত্মসাৎ। এরপর থেকে তিনি অবৈধভাবে সম্পদের মালিক হতে শুরু করেন। প্রতারণার অভিযোগ আড়াল করতে শাহীরুল তার অফিসের ঠিকানা পরিবর্তন করেন। প্রভাবশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একটি বেনামী মানবাধিকার সংস্থা খুলে নিজেকে চেয়ারম্যান পরিচয় দিতেন।
এ ছাড়া ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য নামিদামি ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে সেগুলো প্রদর্শন করতেন এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতেন। তিনি প্রতারণার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেকার ও শিক্ষিত বহু নারী ও পুরুষকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি গার্ড, ড্রাইভার, কম্পিউটার অপারেটর, অফিস সহকারী, বিক্রয় কর্মকর্তা, লাইনম্যান হিসেবে চাকরি দেওয়ার নাম করে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
প্রতারণার যত কৌশল
শাহীরুল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ দিতে চটকদার বিজ্ঞাপন দিতেন। দেশের শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীরা বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে আবেদন করলে, তাদেরকে কৌশলে তার পরিচালিত কোম্পানির মাধ্যমে নিয়োগ দিতে প্রতিশ্রুতি দিতেন। এরপর চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা জামানত হিসেবে গ্রহণ করতেন। তাছাড়া সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা নিতেন।
র্যাব জানিয়েছে, শাহীরুল নিজেকে শুটিং ক্লাবের সদস্য বলে পরিচয় দিতেন। প্রশিক্ষণ, ইউনিফর্ম ও আনুষাঙ্গিক খরচ হিসেবেও টাকা নেওয়া হতো। এভাবে অনেকের কাছ থেকে নামমাত্র নিয়োগ দিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তার অফিস বা বাসায় ঘোরাঘুরি করেও সেই টাকা ফেরত পাননি ভুক্তভোগীরা। বরং টাকা চাইলে অস্ত্র দেখিয়ে ভুক্তভোগীদের ভয়ভীতি দেখাতেন। এ ছাড়া শাহীরুল নিজেকে সরকারি কর্মকর্তা পরিচয় দিতেন। তার বিরুদ্ধে রামপুরা থানায় চাঁদাবাজি ও প্রতারণার অভিযোগে মামলা রয়েছে।
শাহীরুলের কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে- এমন প্রশ্নে মোজাম্মেল হক বলেন, ‘২০০৩ সাল থেকে তিনি প্রতারণায় জড়িত। সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় দুটি বাড়ি, দুটি ফ্ল্যাট, দুটি গাড়ি ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় তার নামে ২৪ কাঠা জমির তথ্য পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৫০ কোটি টাকা সমমূল্যের সম্পদ আমরা পেয়েছি। তবে ব্যাংক, ফিক্সড ডিপোজিট, স্বজনদের নামে কী পরিমাণ সম্পদ আছে, তা এখনও জানা যায়নি।’