‘ওই গাছতলায় দাঁড়াবা, দেখা হবে কাল’
মোজাম্মেল হক মাস্টার, সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার সোনাবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক। তবে শিক্ষকতার পাশাপাশি তাঁর আরো একটি আয়ের উৎস ছিল আম বিক্রি করা। একটি শতবর্ষী ল্যাংড়া আমের গাছ রয়েছে তাঁর। প্রতি বছর অন্তত ৩৫ হাজার টাকার আম বিক্রি করতেন ওই একটি গাছ থেকেই।
কিন্তু গত ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবে রাতভর দিশেহারা ছিল গাছটি। ভয়াল ঝড়ে মাটিতে আছড়ে পড়তে থাকে গাছটির ডালপালা। এভাবে সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়ে পরের দিন ভোর পর্যন্ত ওই ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে একপর্যায়ে আম গাছটি আর টিকতে পারেনি। গাছটির মূল, অর্থাৎ গুড়ি বাদে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না তখন।
শতবর্ষের একটি গাছ এক রাতেই ভেঙে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। এ গাছটিই এক সময় বিভিন্ন ঝড়ের তাণ্ডব থেকে তার আশপাশের বাড়িঘর বাঁচিয়েছিল।
মোজাম্মেল হক এলাকায় মাস্টার সাহেব নামে পরিচিত। আম্পানের তাণ্ডবে তাঁর আরো অনেক গাছের ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু তাঁর কথা, ‘আমার সব যাক, শুধু এ গাছটি যদি বেঁচে থাকত!’
শুধু মাস্টার সাহেব নন, এমন হাজার হাজার মানুষের লাখ লাখ ছোট-বড় গাছ ভেঙে একাকার। অথচ, এ গাছগুলোতে কত মানুষের স্বপ্ন বোনা ছিল।
সোনাবাড়িয়া ইউপির অনেক বৈদ্যুতিক খুঁটিও ভেঙে গেছে। আম্পানের তাণ্ডবে আজ নয়দিন ওই এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। গল্পের ছলে সাজু আহমেদ নামের এক ব্যক্তি বলছিলেন, ‘মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র পথটি ছিল এমন—সকাল ১০টা সময় ওই গাছতলায় দাঁড়াবা, তখন দেখা হবে। গাছ তলায়ই দাঁড়াবা কিন্তু ফয়সাল। ওই সময় আমিও আসব, দেখা হবে। দেরি না হয় যেন, বসে থাকা লাগলে কিন্তু খবর আছে তোমার!’
সাজু আহমেদ বলছিলেন, ‘আজ বন্ধু ফয়সালের জন্মদিন। শুভেচ্ছা জানানোর জন্য হলেও দেখা হবে। এই পরিস্থিতিতে ফয়সালকে বলতে হবে, গাছতলায় এসো, অথবা নির্দিষ্ট সময়ে ওমুক স্থানে থেক। এ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। বৈদ্যুতিক খুঁটি-টুটি ভেঙে একাকার। বিদ্যুৎ নেই আজ নয়দিন হল। আপনি ধরে নিতে পারেন, আমরা ৮০ থেকে ৯০-এর দশকে ফিরে গেছি। যোগাযোগের মাধ্যম বলতে হেঁটে পথ চলা।’
এ ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব টাকা দিয়ে করা যাবে না বলে জানান সাজু। তিনি বলেন, “আমার বাড়ির পাশের মোজাম্মেল হক মাস্টার দুঃখ করতে করতে বলছিলেন, ‘আমার সব যাক, শুধু এ গাছটি যদি বেঁচে থাকত! সারা জীবন ছায়া দিয়েছে আমাকে। আজ সব ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেছে।’ শুধু তাঁরই নয়, এমন ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সী গাছ, সব ভেঙে শেষ, যেসব গাছ সারা জীবন মানুষের আয়ের উৎস ছিল। আমারই উঠানের বড় আম গাছ, ২০ বছর বয়সী লম্বা গাছ, ছোট-বড় আরো ২০টি লম্বা গাছ, কাঁঠাল গাছসহ কয়েকটি মেহগনি—সব ভেঙে শেষ। এ আম বাগানসহ অন্যান্য গাছের ক্ষতিতে সবার মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে।”
ফয়সাল ইসলাম সবুজ, সাজু আহমেদ ও আবু তাহের ছোটবেলার বন্ধু। তিনজনের বাড়ি তিন গ্রামে। কথার প্রসঙ্গে ফয়সাল বলছিলেন, ‘এমন ঝড় আমার দাদারাও কখনো দেখেনি। সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। পুরো এলাকায় কোথাও বিদ্যুৎ নেই। যে রাতে ঝড় হয়েছিল, সেই রাত থেকেই ফোনে চার্জ নেই। কারো সঙ্গে যোগাযোগ নেই। তাই খুঁজে খুঁজে দেখা করলাম বন্ধুদের সঙ্গে।’
আবু তাহের বলেন, ‘মানুষের এত বেশি ক্ষতি হয়েছে, যা বলা যাবে না। কিন্তু এসব কে দেখবে? দেখার মতো কেউ নেই। দুই টাকার ত্রাণে এদের কী হবে? পুরো সাতক্ষীরা অন্তত ১০ বছর পেছনে পড়ে গেল।’
এলাকার মাদরা গ্রামের নুর হোসেন বলেন, ‘যারা মানেুষের ক্ষেতে-খামারে জন (মজুরি) দিয়ে পেট চালায়, তাঁরা সবাই বেকার। এসব মানুষের অভাবের শেষ নেই। আসলে ধনী-গরিব কেউ আম্পানের ক্ষতির হাত থেকে বাদ পড়েনি।’