একেকজনের ২০০০ ছিনতাই, মাঝেমধ্যে হত্যা!
নুরুল ইসলাম মূলত সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক। অটোরিকশা চালানোর আড়ালে তার মূল পেশা ছিনতাই। নুরুল ইসলামসহ আটজন মিলে গড়ে তুলেছে সিএনজিকেন্দ্রিক দুটি ভয়ংকর ছিনতাই ও কিলিং গ্রুপ। রাত ৮টার পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত ঢাকার আশুলিয়া, আবদুল্লাহপুর, উত্তরা, গুলশান, ভাটারা, খিলক্ষেত, বাড্ডা, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, রামপুরা, ৩০০ ফিট, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী ও সাইনবোর্ড এলাকায় চলতে থাকে তাদের অপকর্ম।
নুরুল ইসলাম জানিয়েছে, সে পাঁচ-ছয় মাস ধরে প্রায় ৬০০ ছিনতাই করেছে। তার সহযোগী পাঁচ-ছয়জন আছে, যারা প্রায় তিন-চার বছর ধরে ছিনতাই করছে। অনেকেই দুই হাজার-আড়াই হাজার ছিনতাই করেছে। রাত ৮টায় বের হয়ে সূর্যোদয় পর্যন্ত কমপক্ষে একটি থেকে সর্বোচ্চ ছয়টি পর্যন্ত ছিনতাই করার রেকর্ড আছে।
ভয়ংকর এই ছিনতাই ও হত্যা চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ।
গত ৫ জানুয়ারি গভীর রাতে মগবাজার ফ্লাইওভারের সোনারগাঁও প্রান্তে বেসরকারি এশিয়ান ইউনিভার্সিটির ছাত্র মিজানুর রহমানকে হত্যার ঘটনায় গত ২৩ জানুয়ারি রাতে গাজীপুরের টঙ্গী থেকে নুরুল ইসলাম এবং ২৫ জানুয়ারি গাজীপুরা ও তুরাগ এলাকা থেকে নুরুলের সহযোগী আবদুল্লাহ বাবু ও জালালকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
জিজ্ঞাসাবাদে নুরুল ইসলাম ও তার চক্রের সদস্য জালাল ও আবদুল্লাহ বাবু যে তথ্য দিয়েছে, তা নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের ফেসবুক পাতায় একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর থেকে ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর ভিন্ন ভিন্ন ফ্লাইওভারে পাওয়া যায় চারটি লাশ। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের ধরন একই রকম। সবার গলায় গামছা বা মাফলার প্যাঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত ১০ ডিসেম্বর আক্তার হোসেন নামের এক স্বর্ণকারকে হত্যার পর লাশ ফেলে রাখা হয় কুড়িল ফ্লাইওভারে। ৩১ ডিসেম্বর খিলক্ষেত ফ্লাইওভারে ওঠার পথের ডানপাশে অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়। ৩ জানুয়ারি কুড়িল বিশ্বরোডসংলগ্ন ফ্লাইওভারে মনির হোসেন নামের এক ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায় এবং সর্বশেষ ৬ জানুয়ারি মগবাজার ফ্লাইওভারের ওপরে সোনারগাঁও প্রান্তে রেলক্রসিং বরাবর পাওয়া যায় মিজানুর রহমানের লাশ।
মিজানুর রহমান প্রসঙ্গে ডিসি তেজগাঁওয়ের ফেসবুক পেজে বলা হয়েছে, ৫ জানুয়ারি ২০২০ রাত অনুমান ০১.১২ ঘটিকায় অজ্ঞাত একজন পথচারী হাতিরঝিল থানার অফিসার ইনচার্জের অফিশিয়াল মোবাইল নম্বরে ফোন করে জানায়, মগবাজার ফ্লাইওভারের ওপরে সোনারগাঁও প্রান্তে রেলক্রসিং বরাবর পড়ে আছে এক যুবকের লাশ। মুহূর্তেই হাতিরঝিল থানা পুলিশ চলে যায় ঘটনাস্থলে। ঘটনাস্থলে হাজির হলেন তেজগাঁও বিভাগের ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাবৃন্দ।
ঠোঁটে একছোপ রক্তছাড়া সারা শরীরে কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না।
ফ্লাইওভারের যে অংশে মৃতদেহটি পড়ে ছিল, সেখান থেকে সোনারগাঁও ক্রসিং এবং হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী যে প্রান্তে উঠতে হয় ফ্লাইওভারে, পুরো এলাকা খোঁজা হলো তন্নতন্ন করে। যদি মৃতদেহের পরিচয় শনাক্তকরণের কোনো আলামত পাওয়া যায়!
রাত ০২.২৫ ঘটিকায় ফ্লাইওভারের ওপরে রেইনবো ক্রসিং থেকে সোনারগাঁও প্রান্তের দিকে সামান্য এগোতেই ফ্লাইওভারের রেলিং ওয়াল ঘেঁষে একটি মানিব্যাগ পাওয়া গেল। মানিব্যাগে পাওয়া গেল একটি জাতীয় পরিচয়পত্র ও জব আইডি কার্ড। জাতীয় পরিচয়পত্র ও জব আইডি কার্ডের ছবির সঙ্গে মেলানো হলো মৃতদেহের মুখাবয়বের। শনাক্ত হলো মৃতদেহটি।
মৃতদেহটি মিজানুর রহমানের। বয়স ২৫ বছর। লক্ষ্মীপুর জেলার সদর উপজেলার ছবিলপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবা আমির হোসেন পেশায় মুদি দোকানদার।
বেসরকারি এশিয়ান ইউনিভার্সিটির ছাত্র মিজানুর রহমান শেওড়া এলাকায় একটি মেসে থাকতেন। পড়াশোনার পাশাপাশি বনানীতে অবস্থিত হোটেল ‘গোল্ডেন টিউলিপ’-এর ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ শাখায় ওয়েটার হিসেবে কাজ করতেন মিজানুর রহমান। নিজের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে অবশিষ্ট টাকা পাঠাতেন গ্রামে মুদি দোকানদার বাবাকে।
আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাপানে যাওয়ার কথা ছিল মিজানুর রহমানের। জাপানি ভাষা শেখার কোর্স কমপ্লিট করেছিলেন। পাসপোর্টও করে ফেলেছিলেন। জাপানে কোনো হোটেলে ভালো বেতনে চাকরি করে ঘোচাতে চেয়েছিলেন মা-বাবার নিত্যকার অভাব-অনটন।
অভিনয়েও মিজানুর রহমানের আগ্রহ ছিল যথেষ্ট। মান্না, ডিপজল ও ওমর সানীকে নকল করতে পারতেন হুবহু।
তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের এডিসি হাফিজ আল ফারুকের নেতৃত্বে সহকারী কমিশনার মঈনুল ইসলাম, হাতিরঝিল থানার পরিদর্শক মহিউদ্দীন, উপপরিদর্শক (এসআই) মবিন, এসআই খায়রুল এএসআই তরিকের একটি টিম ২৩ জানুয়ারি রাত ৮টা ২৫ মিনিটে টঙ্গী এলাকা থেকে নুরুল ইসলাম এবং ২৫ জানুয়ারি গাজীপুরা ও তুরাগ এলাকা থেকে আবদুল্লাহ বাবু ও জালালকে গ্রেপ্তার করে।
নুরুল ইসলাম, বাবু ও জালাল ঢাকা মহানগর পুলিশের অধিক্ষেত্রের বাইরে দুটি এলাকায় গত দুই মাসে আরো চারটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। মূলত অটোরিকশায় যাত্রী হিসেবে উঠিয়ে ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় তাদের হত্যা করা হয়। এর পাশাপাশি ছিনতাইয়ের পর অজ্ঞান বা অর্ধমৃত অবস্থায় ৩০-৪০ যাত্রীকে বিভিন্ন ফ্লাইওভার বা নির্জন অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে স্বীকার করেছে নুরুল ইসলাম। এদের মধ্যে আট-দশজন বাস-ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা গেছে।
এ চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তারের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।