একসময় বুঝতে পারি, আমি আসলে ধর্মীয় অপব্যাখ্যার শিকার
ধর্মীয় অপব্যাখ্যার কারণে তাঁরা ডুব দিয়েছিলেন অন্ধকারে। জড়িয়েছিলেন জঙ্গি সংগঠনে। তারপর দীর্ঘদিনের বিচ্ছিন্নতা, ভয় আর আতঙ্কগ্রস্ত জীবনযাপন। অমানিশা কেটে একসময় ভুল বুঝতে পারা, অতপর এক নবদিগন্তের পথে তাঁদের শুভসূচনা হওয়া। সেই সূচনায় আত্মসমর্পণ করে আলোর পথে ফিরে ভালো থাকবেন বলে শপথ নিলেন জঙ্গি সংগঠনের নয়জন সক্রিয় সদস্য।
জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ উপলক্ষে আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীর কুর্মিটোলার র্যাব সদর দপ্তরে ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। সেটি এমনই এক মুহূর্ত ছিল- যা জন্ম দিয়েছিল এক আবেগাপ্লুত আবহের। আনন্দাশ্রু দেখা গেল নতুন জীবন ফিরে আসা নয়জন ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের চোখে। তাঁরা জড়িয়ে ধরলেন মা-বাবাকে। এই দৃশ্য দেখে সেখানে উপস্থিত পরিবার-পরিজন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সাংবাদিকরা করতালির মাধ্যমে তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে স্বাগত জানায়।
ওই নয়জন জামা’আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও আনসার আল ইসলামের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। আত্মসমর্পণ করার পর তাঁরা তাঁদের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেন। কথা বলেন অন্ধকার জগৎ নিয়ে। তাঁদের মধ্যে একজন মাহফুজ শামীম (ছদ্মনাম)। তিনি তাঁর জঙ্গিজীবনের কথা বলতে গিয়ে কাঁদতে থাকেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলছিলেন, ‘অনেক সময় দেখা যেত, নিরাপত্তার কারণে মসজিদে গিয়ে ঠিকমতো নামাজটাও পড়তে পারিনি। সব সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকতাম। একটা সময় আমি আমার ভুল বুঝতে পারি। বুঝতে পরি যে, আমি আসলে ধর্মীয় অপব্যাখ্যার শিকার।’
মাহফুজ শামীম বলেন, ‘আমি একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছিলাম। সে সময় আমি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্মীয় বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যায় আকৃষ্ট হই। ২০০৯ সালে আমি জঙ্গি সংগঠনের দাওয়াতি শাখায় কাজ শুরু করি। তারপর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আমি সেই জঙ্গি সংগঠনে সক্রিয়ভাবে সংযুক্ত থাকি। একপর্যায়ে কিছু সংখ্যক বন্ধুকেও আমি আকৃষ্ট করতে পারি। তবে এখনো পর্যন্ত আমি নিজে কোনো নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হইনি।’
মাহফুজ শামীম আরো বলেন, ‘একপর্যায়ে ২০১৬ সালে আমার ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীল নেতার নির্দেশনায় হিজরত করে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হই এবং সংগঠনটির দায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় চলে আসি। ২০১৭ সালে স্থায়ীভাবে পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসি। এরপর সংগঠনের ম্যানেজমেন্ট শাখায় দায়িত্ব পালন করতে থাকি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে আমি বাধ্য হয়ে পরিবার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলি। আমি এবং আমার পরিবার তখন থেকেই চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকি। হিজরতে থাকাকালীন আমার এবং আমার পরিবারের ওপর অসহনীয় দুর্ভোগ নেমে আসে।’
আজ নতুন জীবন পেয়ে আপ্লুত মাহফুজ শামীম বলেন, ‘পুরো সমাজ থেকে আমি এবং আমার পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। আমার স্ত্রী একজন চিকিৎসক। তাঁর জীবনেও অসহনীয় দুর্ভোগ নেমে আসে। আমার অনাগত সন্তানদের জীবনে কালো ছায়া নেমে আসে। এক কথায় আমার সামাজিক-পারিবারিক জীবন বলতে কিছু ছিল না। আমি যে পথে হেঁটেছি, সে পথ ভুল পথ। তলোয়ারের ঝনঝনানি, এটা সেই যুগের কথা। এখনকার কথা হলো, জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগ। শিক্ষার যুগ। মননশীলতার যুগ। সবকিছু বুঝে আজ এক নতুন জীবনের জন্ম হলো। সেজন্য র্যাবসহ বাংলাদেশ সরকারকে আমি ধন্যবাদ জানাই।’
মাহফুজ শামীমের পরে কথা বলেন তাঁর বাবা মাহামুদুল হাসান (ছদ্মনাম)। কথা বলতে বলতে তিনি উচ্চস্বরে কেঁদে ওঠেন। তিনি বলেন, ‘অনেকদিন শামীমের মুখে বাবা ডাক শুনিনি। আমার পুত্রবধূ ও দুই নাতিকে দেখতে পাইনি। আদর করতে পারিনি। আমি, আমার ছেলে-পূত্রবধূ ও দুই নাতিকে কোলে তুলে নেওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। আজকে আমি তাদের কাছে ফিরে পেয়ে খুবই অনন্দিত। সন্তান বিপথে চলে গেলে তার মা-বাবা বুঝেন সেটা কত বেদনার। আগামীতে যাতে কোনো মা-বাবার সন্তান বিপথে না জড়ায় সেই দোয়া থাকল। আজ যাঁরা বিপথ থেকে ভালো পথে পা রেখেছেন তাঁদের জন্য শুভ কামনা। আর বিপথে যাওয়া সন্তানকে কাছে ফিরে পাওয়াতে সহযোগিতা করার জন্য র্যাবসহ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’