উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় দিচ্ছেন অনেক বিচারপতি
ক্রমে উচ্চ আদালতে বেড়েছে বাংলা ভাষার ব্যবহার। অনেক বিচারপতি নিয়মিত বাংলায় লিখে চলেছেন আদেশ ও রায়। এর মধ্যে এক বিচারপতি গত ১০ বছরে লিখেছেন প্রায় ১৫ হাজারের বেশি রায় ও আদেশ।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার দপ্তর সূত্রে জানা যায়, বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন এ পর্যন্ত ১৫ হাজারের বেশি রায় ও আদেশ লিখেছেন বাংলায়। ফলে বিচারপ্রার্থী সাধারণ মানুষ স্বস্তিবোধ করছে।
এদিকে ইংরেজিতে দেওয়া আদালতের রায়গুলো সহজেই বাংলায় অনুবাদ করার জন্য সম্প্রতি ‘আমার ভাষা’ নামের একটি সফটওয়্যারের উদ্বোধন করা হয়েছে। এতে বিচার বিভাগের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে যায়, গত বছর আলোচিত পিলখানা হত্যা মামলায় ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। দেশের ইতিহাসে এ মামলার আসামির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আর রায়ের পৃষ্ঠার সংখ্যার দিক থেকেও এটি সবচেয়ে বড় রায়। সেই রায়ের ১৬ হাজার ৫৫২ পৃষ্ঠা বাংলায় লিখে আলোচনায় এসেছেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী। ওই রায়ের অনুলিপি সংরক্ষণের জন্য বাংলা একাডেমিতে হস্তান্তর করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান বেশির ভাগ রায়, আদেশ ও নির্দেশ বাংলায় দিচ্ছেন। ১৫ হাজারের বেশি রায় বা আদেশ বাংলায় দিয়েছেন তাঁরা।
গত বছর ভাষার মাসে বাংলায় রায় ও আদেশ দেওয়া শুরু করেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিমের হাইকোর্ট বেঞ্চ। সে বছর ভাষার মাসে তিনি বিভিন্ন মামলায় এক হাজার ১৭৫টি রায় ও ৬৩৭টি আদেশ বাংলায় দিয়েছেন। এই বেঞ্চ গত ১৭ ফেব্রুয়ারি আলোচিত গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলার রায়ও দিয়েছেন বাংলায়।
১৯৯৯ সালে উচ্চ আদালতের কয়েকজন বিচারক বাংলায় রায় লেখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এরপর ২০০৬ সাল পর্যন্ত হাইকোর্ট বিভাগে কোনো রায় বাংলা ভাষায় দেওয়া হয়নি। ২০০৭ সাল থেকে হাইকোর্ট বিভাগে দেওয়ানি, ফৌজদারি ও রিট মামলায় কয়েকটি রায় বাংলায় দেওয়া হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ২০০৭ সাল থেকে ২০১১ সালে অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ২০০ রায় বাংলা ভাষায় লিখেছেন।
দেশের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন বিষয়ে এবং বেতার ও দূরদর্শনে বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ এবং দূষণ রোধে হাইকোর্টের রুলসহ নির্দেশনা রয়েছে। দুটি নির্দেশনাই এসেছে ফেব্রুয়ারি মাসে। একটি ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, অন্যটি ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। একটির ক্ষেত্রে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে, অন্যটিতে রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলায় আদেশ দেন হাইকোর্টের পৃথক দুটি বেঞ্চ। কিন্তু এর বাস্তবায়নও এখনো কার্যকর হয়নি।
বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে ৯৯ জন বিচারপতি আছেন। হাইকোর্টে এক সময় বাংলায় রায়-আদেশ দেওয়া চিন্তা করাও কঠিন ছিল। তবে বর্তমানে বিচারপতিদের যাঁরা বাংলায় রায় লিখেন, তাঁরা তা লিখছেন মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার টানে। বাংলা ভাষার ব্যবহার আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে বলে মনে করেন তাঁরা। এর মধ্যে বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম, বিচারপতি ফারাহ মাহবুব, বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী, বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ, বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান, বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম, বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার, বিচারপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন খান, বিচারপতি মো. জাকির হোসেন, বিচারপতি জাহিদ সারোয়ার কাজলসহ অনেক বিচারপতিই বাংলায় রায় দিচ্ছেন। অনেক বিচারপতি এখন ফেব্রুয়ারি মাসে মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েও বাংলায় রায় লেখেন।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বাংলায় রায় ও আদেশ দেওয়াটা অত্যাবশ্যক। কারণ দেশের নাগরিক বিশেষ করে, যারা গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন, তাদের মামলার রায় ও আদেশ মাতৃভাষায় হওয়া বাঞ্ছনীয়। তা ছাড়া আমরা বহু আগেই ঔপনিবেশিক আমল পেরিয়ে এসেছি। তাই সেই মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসাও অত্যন্ত জরুরি ও প্রাসঙ্গিক।’
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘অন্তত বিচারপ্রার্থীদের কথা চিন্তা করে আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার আরও বাড়ানো উচিত। এক সময় ছিল আদালতের সবকিছু ইংরেজি ভাষায় পরিচালিত হতো, এখন সেই পরিস্থিতি নেই। দিন দিন বাংলা ভাষার কদর আদালতে বাড়ছে। অনেক বিচারপতি আছেন যারা নিয়মিত বাংলায় রায় ও আদেশ দিচ্ছেন।’