ইলিয়াসকে নিয়ে আমার বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে : মির্জা আব্বাস
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস অভিযোগ করে বলেছেন, ‘নিখোঁজ’ ইলিয়াস আলীকে নিয়ে গতকাল শনিবার তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন গণমাধ্যম সেই বক্তব্য বিকৃত করে ছেপেছে।
বিএনপির শীর্ষস্থানীয় এই নেতা বলেন, ‘কাল কথা বলার পর কতগুলো সংবাদপত্র ও কতগুলো ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ভাবসাব দেখলাম। যত তাড়াতাড়ি মির্জা আব্বাসকে জবাই করতে পার, তা লিখ। সরকার বা আওয়ামী লীগ ইলিয়াস আলীকে গুম করেনি, একথা আমি বলিনি। গণমাধ্যমে আমার কথাকে, বক্তব্যকে টুইস্ট করা হয়েছে, বিকৃত করা হয়েছে।’
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাজধানীর বনানী থেকে গাড়িচালক আনসার আলীসহ ‘নিখোঁজ’ হন সিলেট-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী। রাস্তায় পড়ে থাকা তাঁর গাড়ি উদ্ধার করে বনানী থানার পুলিশ। এখন পর্যন্ত তাঁর সন্ধান পায়নি পুলিশ ও পরিবার। গতকাল ছিল ইলিয়াস আলী ‘নিখোঁজের’ নবম বছর।
এ উপলক্ষে গতকাল সিলেট বিভাগ জাতীয়তাবাদী সংহতি সম্মেলনী–ঢাকার উদ্যোগে এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস।
ভার্চুয়াল সভায় একপর্যায়ে মির্জা আব্বাস বিএনপির মহাসচিবের উদ্দেশে বলেন, ‘ইলিয়াস গুমের পেছনে আমার দলের অভ্যন্তরে লুক্কায়িত যে বদমাইসগুলো আছে, তাদেরকে একটু দয়া করে একটু আইডেন্টিফাই (শনাক্ত) করার ব্যবস্থা করেন, প্লিজ।’
‘ইলিয়াস গুম হওয়ার আগের রাত্রিবেলা দলীয় অফিসে কোনো এক ব্যক্তির সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয় মারাত্মকরকম। পেছন থেকে দংশন করার এই সাপগুলো আমার দলে রয়ে গেছে। যদি এদেরকে আপনারা দল থেকে বিতাড়িত না করেন এখন পর্যন্ত, সামনে দলকে আগাতে পারবেন না’, যোগ করেন মির্জা আব্বাস।
ভার্চুয়াল এই সভায় ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদির লুনা ছাড়াও বক্তব্য দেন বিএনপিনেতা শামসুজ্জামান দুদু, আসাদুজ্জামান রিপন, খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, জহিরউদ্দিন স্বপন, আজিজুল বারী হেলাল, কামরুজ্জামান রতন প্রমুখ।
মূলত মির্জা আব্বাসের এই বক্তব্য গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে রাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। অনেকেই বিষয়টি নিয়ে বিএনপির শীর্ষনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতেই গণমাধ্যমের কাছে নিজের অবস্থানকে পরিষ্কার করার জন্য আজ রোববার বিকেল ৪টার দিকে রাজধানীর শাহজাহানপুরের নিজের বাসায় সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। গতকাল যারা ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন; তাদের মধ্যে আজকের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএনপিনেতা ফজলুল হক মিলন, আসাদুজ্জামান রিপন, খায়রুল কবির খোকন, কামরুজ্জামান রতন।
‘আমি কখনও ইউটার্ন নিই না’
সংবাদ সম্মেলনে মির্জা আব্বাস গণমাধ্যমের সমালোচনা করে বলেন, ‘এই যে, গণমাধ্যমে এ বক্তব্যগুলো এলো, এগুলো কেন দেওয়া হলো আমি জানি না। আমার সহজ-সরল মনের সরল উক্তিগুলোকে বিকৃত করে আমার সাংবাদিক ভাইদের যার যেখানে প্রয়োজন, যতটুকু প্রয়োজন, পুরো বক্তব্যের বিরাট অংশ না দিয়ে একটা লাইন দেওয়া হয়েছে। যার যেখানে প্রয়োজন কেটেছিঁড়ে, পোস্টমর্টেম করে, কাটপিস করে, ইচ্ছেমতো লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেন করা হয়েছে তাও আমি জানি না।’
“‘বিএনপির নেতারাই ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে’- এটাও শিরোনাম করা হয়েছে”- এমনটা উল্লেখ করে মির্জা আব্বাস সাংবাদিকদের কাছে প্রশ্ন রাখেন, ‘বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য হয়ে এ কথাটা কি আমি বলতে পারি? এটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব? অর্থাৎ নিজের মাথায় নিজের বন্দুক তাক করা সম্ভব?’
“বিএনপির বিরুদ্ধে যত কথা সম্ভব সাংবাদিকরা লিখতে পারবে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কিছু লিখতে পারবে না। আমি গতকাল ইলিয়াস আলীর গুমের নবম বছরের একটা অনুষ্ঠানে কথা বলেছি। আমি কথা বলার এক ঘণ্টারও কম সময়ে একটা সংবাদমাধ্যম নিউজ করেছে, ‘মির্জা আব্বাসের ইউটার্ন’। আমি কখনও ইউটার্ন নিই না”, যোগ করেন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক এই মেয়র।
‘দুঃখিত, আমি হয়তো আপনাদের বুঝাতে পারিনি’
আজ সকালে একজন সাংবাদিক ইলিয়াস আলীর বাসায় গিয়ে রীতিমত জেরা করেছে। আজ ইলিয়াস আলীর জন্য সাংবাদিকদের কেন এত মাথা খারাপ হয়ে গেলো- এই প্রশ্নও তুলেন মির্জা আব্বাস।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘আমি এমন কোনো কথা বলিনি যার জন্য জাতির কাছে, দেশের কাছে, দলের কাছে, বিএনপির কাছে, এমনকি আমার নেতাকর্মীদের কাছে আমাকে বিব্রত হতে হবে। আমার বক্তব্য যারা শুনেছেন তাঁরা হয়তো বুঝে উঠতে পারেননি। দুঃখিত, আমি হয়তো আপনাদের বুঝাতে পারিনি।’
সাবেক এই মন্ত্রী অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি গতকালের বক্তব্যের বিষয়ে আবারও বলছি, আমার বক্তব্যের সামনের অংশ, পেছনের অংশ বাদ দিয়ে, মাঝ থেকে একটু নিয়ে, যার যেখানে প্রয়োজন, মনের মাধুরি মিশিয়ে নিজের মতো করে লিখেছেন। এর সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নাই। এজন্য আমার দল বা আমি কোনো দায়দায়িত্ব বহন করি না। যারা বলেছেন, যারা লিখেছেন, তাঁরা এই দায় নিবেন। আমি যা বলেছি, আমার সংগঠনের ভালোর জন্য বলেছি। কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য বলি নাই। আমি যা বলেছি, ইলিয়াসকে স্মরণ করে বলেছি।’
‘আমি কটাক্ষ করে বলেছি’
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আমি একজন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য। কেন বলব যে, সরকার জড়িত না। এটা আমি কটাক্ষ করে বলেছি। তাহলে সরকারই বলুক ইলিয়াস আলী কোথায় আছে? তাহলে সরকারকে জবাব দিতে হবে। সরকারের সময় একজন ইলিয়াস, জলজ্যান্ত একজন মানুষকে তুলে নিয়ে গেল, গুম হয়ে গেল, সরকার জানে না। কে করল তাঁকে গুম? আমি একথা বলতে চেয়েছি।’
এ সময় সাংবাদিকদের উদ্দেশে বিএনপির শীর্ষ এই নেতা বলেন, ‘দয়া করে আপনারা আর টুইস্ট করে সংবাদ করবেন না। আমি বুঝলাম না, হঠাৎ করে আমাকে টার্গেট করার প্রয়োজন কেন হলো- এই সরকারের কিংবা আমার সাংবাদিক ভাইদের? কেন প্রয়োজন হয়ে গেল আমাকে টার্গেট করার? এত লোক থাকতে আমাকে টার্গেট করা কেন? ইলিয়াসকে লক্ষ্য করে আমাকে টার্গেট করার লক্ষণটা কিন্তু ভালো না। আমি একে অশুভ লক্ষণ বলে মনে করি।’
এম ইলিয়াস আলী গুমের আগের দিন কার সঙ্গে পার্টি অফিসে ঝগড়া হয়েছে, কে সেই ব্যক্তি- সাংবাদিকরা সেই ব্যক্তির নাম জানতে চাইলে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘ইলিয়াসের সঙ্গে তো আমার ঝগড়া হতো। ইলিয়াস এমন এক মেজাজের লোক ছিলো; রতন, মিলন, খোকন এদের সামাল দিতে আমার বেগ পেতে হতো। সুতরাং, একটা দলে কার সঙ্গে কার কী ছিলো- এ নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কী আছে? ওই দিন অফিসে কত লোকের সঙ্গে কত লোকের ঝগড়া হইছে, মনোমালিন্য হইছে, এটাতো হইতেই পারে। কার সঙ্গে কার হইছে- বলা তো ডিফিক্যাল্ট। আমি বলেছি, আমার দলের মধ্যে যদি কেউ থাকে এদেরকে দলের বাচাই করা দরকার।’