‘আরো রেস্ট্রিকটেড মুভমেন্ট’ চেয়ে টেকনিক্যাল কমিটির সুপারিশ
ছোটখাটো যানবাহন খানিকটা গণপরিবহনে রূপ নিয়েছে। ফলে উপচেপড়া মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে রাজধানীতে। নীরব শহর সরব হতে শুরু করেছে। কারণ, দুদিন পরই, অর্থাৎ ৩১ মে খুলছে অফিস-আদালত। সে ঘোষণা সরকার এরমধ্যে দিয়েছে। কিন্তু সরকারকে ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার সুপারিশ করেছে করোনা প্রতিরোধে গঠিত ‘জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি’।
টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির দাবি, করোনাকালের এখন পর্যন্ত সামগ্রিক পরিস্থিতি যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে থাকলে একদিন শতভাগ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হবে। আমি বা আপনি আক্রান্ত হতে আর কেউ বাদ থাকব না। কারণ, টিকা আবিষ্কার হওয়ার আগে কোভিড-১৯ শেষ হয়ে যাচ্ছে না। তাই কমিটি মনে করে, সরকারকে করোনারোধে বরং আরো কঠোর অবস্থানে যাওয়া উচিত। কঠোরভাবে ‘প্রপার লকডাউন’ কার্যকর করা উচিত।
দেশে করোনাভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার ১৭ সদস্যের একটি ‘জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি’ গঠন করে। ওই কমিটির সভাপতি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য (ভাইরোলজিস্ট) অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। করোনাকাল, লকডাউন এবং হঠাৎ অফিস খোলা; এসব নিয়ে তাঁরা দুজনই কথা বলেছেন এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে।
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা গতকাল সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি সুপারিশপত্র জমা দিয়েছি। সেখানে আমরা প্রপার লকডাউনের কথা বলেছি। এভাবে চলতে থাকলে সংক্রমণ বাড়বে। একটা সময় হয়তো সেটা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তখন আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপরও চাপ পড়বে। এখন আমাদের দেশে নিয়মিত সংক্রমণের হার বাড়ছে। এ অবস্থায় লকডাউন শিথিল তো নয়ই, বরং আরো প্রপার লকডাউন কার্যকর করা উচিত। আমরা সেই পরামর্শই দিয়েছি। এখন পর্যন্ত কিন্তু আমাদের দেশে কখনো আসলে লকডাউন ছিল না। ছিল সাধারণ ছুটি। তেমন কাউকে লকডাউন মানতে দেখা যায়নি। জনগণ যদি লকডাউন না মানতে চায়, তাহলে কারফিউ জারি করা উচিত। অন্তত যত দিন টানা দুই সপ্তাহ সংক্রমণের হার নিম্নগামী না হয়। এরপর একটা সময় সবকিছু শিথিল করা যাবে। কিন্তু এখন প্রতিদিন সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। এ অবস্থায় সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবা উচিত। আমরা চাই, সরকার আরো রেস্ট্রিকটেড মুভমেন্টের পথে হাঁটুক। সেই সুপারিশ আমরা করেছি।’
ডা. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা মোট আটটি পরামর্শ দিচ্ছি সরকারকে। এর ভেতরে হাসপাতালের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে বলেছি। সব হাসপাতালে যেহেতু কোভিড রোগীর চিকিৎসা হবে, সেহেতু কোন কোন পথে আগানো উচিত সেটা বলছি। সব হাসপাতালকে আমরা গ্রিন জোন (নন-কোভিড), ইয়োলো (কোভিড হতেও পারে, নাও পারে) এবং রেড জোনে (কোভিড) ভাগ করার কথা বলছি। এসব করতে নিয়োগ থেকে শুরু করে যা যা করা উচিত, তা-ই করতে বলেছি। সব মিলিয়ে কমিটির পক্ষ থেকে আমরা সুপারিশ করেছি। বাকিটা সরকারের চিন্তা-চেতনা আর মনোভাবের ব্যাপার।’
বর্তমান পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এখন মানুষ মুভমেন্ট (চলাফেরা) করছে। এতে লাফিয়ে লাফিয়ে আক্রান্তের হার বাড়বে, যা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকবে। এভাবে চলতে থাকলে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। করোনাকালের সাময়িক অর্থনীতিকে বাঁচাতে গিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ভেঙে পড়তে পারে আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো। তখন কী হবে?’
কিন্তু এভাবে আরো দীর্ঘদিন লকডাউন রাখার ক্ষমতা আমাদের আছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম বলছিলেন, ‘ধরেন, আপনার গার্মেন্টেসের কিছু পণ্যের অর্ডার আছে বিদেশি বায়ারদের কাছে। এই কারণ দেখিয়ে আপনি গার্মেন্টস শ্রমিকদের ঢাকায় ঢোকালেন। এর পর থেকে আক্রান্তের হার বাড়া শুরু করল। বাড়তে বাড়তে যদি সেটা চরম মাত্রায় পৌঁছায়, তখন কী হবে? কে উৎপাদন করবে তখন? আক্রান্তের হার অনেক বেশি হয়ে গেলে তখন বিদেশি বায়াররাও আর নতুন অর্ডার করতে চাইবে না। অন্য কোনো দেশ থেকে সে অর্ডার করবে। যেখানে তুলনামূলক করোনার অবস্থা ভালো। তখন আপনার অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? সে জন্য আমাদের একটু কষ্ট করতে হবে। আপাতত মানিয়ে নিতে হবে। ক্ষতি তো হচ্ছেই।’
জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘গতকাল বৃহস্পতিবার আমরা পুরো টেকনিক্যাল কমিটি বৈঠকে বসেছিলাম। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কিছু সুপারিশ দেওয়ার। বৃহস্পতিবার এই সুপারিশপত্র পৌঁছে গেছে। সেখানে আমরা চলমান লকডাউনকে শিথিল নয়, বরং আরো কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করার সুপারিশ করেছি। এর আগে যখন একবার দোকানপাট বন্ধ করে দিল সরকার, তখনো কিন্তু সঠিকভাবে লকডাউন মেনে চলা হয়নি। দেখা গেছে, মূল সড়কে দোকান বন্ধ কিন্তু গলির ভেতরে পুরো লোকজনে একাকার অবস্থা। আমরা চাই, সেটাকেও কঠোরভাবে দেখা হোক। লকডাউন মানেই লকডাউন। নতুবা এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া আমাদের জন্য খুবই কঠিন হবে। লকডাউন তুলে নিতে সরকারের সিদ্ধান্ত সংক্রমণ বাড়ার সিদ্ধান্ত।’
লকডাউন তুলে নিলে এবং মানুষ আগের মতো স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে শুরু করলে পরিস্থিতি কী হতে পারে- তা নিয়ে বলতে গিয়ে নজরুল ইসলাম বলছিলেন, ‘আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, পরিস্থিতি যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে থাকলে একদিন আমি-আপনি সবাই করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হব। কারণ, এভাবে মানুষের সংস্পর্শে গেলে আক্রান্ত হওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ থাকবে না। দফায় দফায় মানুষ আক্রান্ত হতে থাকবে। আপনি কোনো না কোনোভাবে আক্রান্ত হবেনই। ওই তালিকায় আমি-আপনিও পড়ব। আমরা সবাই, মানে দেশের শতভাগ মানুষ একদিন করোনায় আক্রান্ত হবে।’
সামনের পরিস্থিতি কী হতে যাচ্ছে তাহলে- এমন প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘দেখুন, মোট আক্রান্তের ৫৬ ভাগ শহরের মানুষ ঈদের ছুটি কাটাতে গ্রামে গেছেন। তাঁদের অনেকের শরীরে হয়তো ভাইরাসটি ছিল, কিন্তু কোনো উপসর্গ ছিল না। তিনি গ্রামে গিয়ে ভাইরাসটি ছড়িয়েছেন। সেখানে এখন অনেকে আক্রান্ত হতে শুরু করবেন। দ্রুতই একটি রাইজ টাইম যাবে। এই ধরুন, আগামী ৯ জুনের দিকে হঠাৎ দেখবেন রোগী বেড়ে যাবে।’
ভাইরাস সংক্রমণের পিকটাইমটা কবে নাগাদ হতে পারে বলে ধারণা করছেন- এমন প্রশ্নে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এখন দুই হাজার করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে। আগামীতে যখন পাঁচ হাজার আক্রান্ত হবে, তখনো এটাকে কিন্তু পিকটাইম বলা যাবে না। এ পরিস্থিতিতেও সচেতন না হলে এটার পিকটাইম এক বছর পরও আসতে পারে! মানে যখন ভ্যাকসিন আবিষ্কার হবে তখন। এর ভেতরে ক্রমান্বয়ে রোগী বাড়ার সম্ভাবনা থাকবে। এখন যদি সবাই ঢাকায় পুনরায় ঢোকেন, তাহলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। ২৬ এপ্রিলে পোশাক শ্রমিকরা ঢাকায় ফিরলেন। তারপর ১০ মের দিকে কিন্তু রোগী হঠাৎ করে বেড়েছিল। ঈদে গ্রামে ফেরা, আবার ঢাকায় আসা এসব কারণে আগামী ৯ জুনের দিকে আরেকটা রাইজ টাইম যাবে আমাদের। এভাবে রাইজ টাইম কতবার যাবে আর পিকটাইম কখন আসবে, তা এখনই বলা মুশকিল।’
এদিকে, গতকাল জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কোভিড-১৯ একটি সংক্রামক রোগ, যা হাঁচি-কাশি ও সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়। জনসমাগম এ রোগের বিস্তার লাভের জন্য সহায়ক এবং সংক্রমণের হার সুনির্দিষ্টভাবে না কমার আগে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালু করলে এ রোগে আক্রান্তের হার বাড়ার আশঙ্কা থাকে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রযোজ্য বিধিবিধানগুলো সঠিক পদ্ধতিতে প্রয়োগ না করে শিথিল করা হলে রোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, এ ছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুনির্দিষ্টভাবে কোভিড-১৯ রোগে হাইড্রোক্সি-ক্লোরোকুইন নামক ওষুধ ব্যবহারের ঝুঁকির বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে উল্লেখ করে কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় এ ওষুধ না রাখার পরামর্শ দিয়েছে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা মন্ত্রণালয় কোভিড-১৯ ও অন্যান্য রোগীর চিকিৎসা একই হাসপাতালে পৃথক ব্যবস্থা করার যে নির্দেশনা দিয়েছে, তা সঠিক উল্লেখ করে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি এ বিষয়ে প্রশাসনিক, সাংগঠনিক, জনবল ও সরঞ্জামের বিশেষ প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে বলে মনে করে টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি।