আমি হাসপাতাল থেকে পালাইনি : ভারত থেকে আসা করোনা রোগী
যশোর জেনারেল হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডের রেড জোন থেকে চলে যাওয়া সাতক্ষীরার মিলন হোসেন দাবি করেছেন, তিনি হাসপাতাল থেকে পালাননি। চিকিৎসক তাঁকে ছাড়পত্র দিয়ে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলেছেন।
মিলন হোসেনের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর গ্রামে। গত ২৩ এপ্রিল তিনি ভারত থেকে বেনাপোল স্থলবন্দর হয়ে বাংলাদেশে আসেন। তিনি ভারতের কলকাতার একটি হাসপাতালে করোনার নমুনা পরীক্ষা করান। ফলাফল আসে ‘করোনা পজিটিভ’। বেনাপোল থেকে পুলিশ তাঁকে যশোরের ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান।
মিলন হোসেনের দাবি, “দুপুর ১টা থেকে দেড়টার ভেতরে আমি হাসপাতালে ভর্তি হই। পকেটে তেমন কোনো টাকা না থাকায় ডাক্তারকে আমি বাসায় যাওয়ার কথা জানাই। সন্ধ্যার দিকে ডাক্তার আমাকে একটি রিসিপ্ট (ছাড়পত্র) দেন। সে সময় ডাক্তার আমাকে বলেন, ‘আপনি বাসায় যেতে পারবেন। কিন্তু বাসা থেকে ১৪ দিন বের হতে পারবেন না। মানে, হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে।’”
কিন্তু হাসপাতাল থেকে বলা হচ্ছে, আপনি পালিয়ে বাড়িতে গেছেন, এমন কথার জবাবে মিলন হোসেন বলেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি পালিয়ে আসিনি। পুলিশ আমার পাসপোর্ট হাসপাতালে জমা দিয়েছিল। আমি যদি পালিয়ে আসতাম তাহলে কি আমার কাছে পাসপোর্ট থাকত? কিন্তু আমার কাছে তো পাসপোর্ট আছে, যেটা হাসপাতালই আমাকে দিয়েছে। তারপর আমি মোটরসাইকেল ভাড়া করে আমার বাড়ি প্রতাপনগরে চলে আসি।’
আপনার করোনা ধরা পড়ল, আপনি ভারত থেকে বাংলাদেশে এলেন কেন, এমন প্রশ্নে মিলন বলেন, ‘আমার ভিসার মেয়াদ ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত। সে জন্য আমি চলে এসেছি।’
‘আমাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হলো। এখন আবার পুলিশ-প্রশাসন থেকে সবাই আমার কাছে নানা কিছু শুনতে আসছে। এখন আমার কথা হলো, আমার সমস্যা থাকলে আমাকে ছাড়া হলো কেন?’, যোগ করেন মিলন হোসেন।
আশাশুনি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শফিউল্লাহ মোল্লা আজ বিকেলে মিলন হোসেনের বাড়িতে যান। ওই বাড়িতে থাকা অবস্থায় তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেছি মিলন পালিয়ে আসিনি। তাঁর কাছে থাকা পাসপোর্টও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ফেরত দিয়েছে। এখন আবার শুনেছি, তাঁকে যশোরের হাসপাতালে নেওয়া হবে। আমার মনে হচ্ছে, এখানে হাসপাতালের গাফিলতি রয়েছে।’
মিলনের বাবা জালাল ঢালী। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে পালিয়ে আসেনি। হাসপাতাল থেকে একটি কাগজ দিয়েছে। এক কলেজের প্রিন্সিপাল কাগজটি দেখেছেন। তিনি বলেছেন, এটা ছাড়পত্র। হাসপাতাল থেকে তো আমার ছেলের পাসপোর্টও ফেরত দিয়েছে। বাড়িতে আসার পর থেকে আমার ছেলে ঘরের মধ্যে আছে। বের হচ্ছে না।’
মিলন হোসেনের বাড়ি প্রতাপনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে। ওই ওয়ার্ডের সদস্য মো. মোকছেদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা শুনেছি, মিলন পালিয়ে আসেনি। তবু পুলিশ আমাদের জানানোর পর ওদের বাড়িতে গিয়ে হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করে এসেছি।’
প্রতাপনগর ইউপির চেয়ারম্যান শেখ জাকির হোসেন বলেন, ‘ঘটনা শোনার পর আমি মেম্বারকে জানাই। তারপর চৌকিদার পাঠিয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে সে (মিলন) বাড়ি থেকে বের না হয়।’
যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের কাছে দাবি করে, ভারত থেকে আসা সাতজনসহ ১০ জন করোনা রোগী গত ১৮ এপ্রিল থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গেছেন। ১৮ এপ্রিল থেকে ২৪ এপ্রিল সময়ের মধ্যে সাতজন বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ফেরেন। এরপর থেকে বিষয়টি আলোচনার জন্ম দেয়। কারণ, এরই মধ্যে ভারতে পাওয়া করোনার ট্রিপল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্ট আতঙ্কে ভুগছে বাংলাদেশের লোকজন।
আজ বিকেলে যশোর জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) আরিফ আহম্মেদ এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘মোট ১০ জন করোনা রোগী পালিয়েছেন। তাদের মধ্যে ভারত থেকে আসা সাতজন ও স্থানীয় আরও তিনজন। এই দশজনের মধ্যে দুই-তিনজন মনে হয় ভর্তি হয়ে করোনা ইউনিটে চিকিৎসা নিয়েছেন। বাকিরা টিকেট কেটেছেন, কিন্তু ভর্তি হয়ে ছিলেন না। মানে, ইমারজেন্সি থেকে ১০ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে তাঁরা আর হাসপাতালে ভর্তি হননি। আমাদের না জানিয়ে চলে গেছেন।’
১৮ এপ্রিল থেকে ২৪ এপ্রিল সময়ের মধ্যে তাঁরা হাসপাতালে যান। এই যে বিভিন্ন সময় তাঁরা হাসপাতাল থেকে চলে গেছেন, আপনারা সতর্ক ছিলেন না—এমন প্রশ্নে আরিফ আহম্মেদ বলেন, ‘তারা আসলে ইমারজেন্সি থেকে টিকেট কেটে আর করোনা ইউনিটে ভর্তি হননি। আমাদের না জানিয়ে চলে গেছেন। তাহলে আমরা কীভাবে বুঝব? না বলে চলে যাওয়া মানে পালিয়ে যাওয়া। তবে এদের মধ্যে দুই-তিনজন বোধহয় হাসপাতালের ভর্তি ছিলেন।’
মিলন হোসেন পালিয়ে যাননি বলে এই প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন সন্ধ্যার দিকে। মিলনের এই দাবির বিষয়ে জানতে সন্ধ্যার পর থেকে আরিফ আহম্মেদকে তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি তা ধরেননি।
তবে যশোরের সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন বলেন, ‘মিলন হোসেনকে যদি হাসপাতাল ছাড়পত্র দিয়ে থাকে, তাহলে তিনি ছাড়পত্র নিয়ে পুনরায় হাসপাতালে আসবেন। আর ১৮ থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে আসা রোগীরা কীভাবে পালালেন, তা জানতে তদন্ত করা হবে। হাসপাতালের কোনো গাফিলতি ছিল কি না তাও তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া ইমিগ্রেশন পুলিশ রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে আসার পর তাঁরা কীভাবে পালিয়ে গেছে বা পুলিশের কোনো গাফিলতি ছিল কি না তাও তদন্তের বিষয়।’
ভারত থেকে আসা সাতজনসহ যে ১০ জন হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গেছেন বলে দাবি করা হচ্ছে তাঁরা হলেন যশোর শহরের পশ্চিম বারান্দিপাড়া এলাকার বিশ্বনাথ দত্তের স্ত্রী মণিমালা দত্ত (৪৯), সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর গ্রামের মিলন হোসেন (৩২) ও কালীগঞ্জ উপজেলার শেফালি রানী সরদার (৪০), রাজবাড়ী সদর উপজেলার রামকান্তপুর গ্রামের নাসিমা আক্তার (৫০), খুলনা সদর উপজেলার বিবেকানন্দ (৫২), পাইকগাছা উপজেলার ডামরাইল গ্রামের আমিরুল সানা (৫২) ও রূপসা উপজেলার সোহেল সরদার (১৭), যশোর সদরের পাঁচবাড়ীয়ার ফাতেমা (১৯) ও রুমা (৩০) এবং যশোর সদরের ওমাদা গ্যারেজ এলাকার প্রদীপ বিশ্বাস।