‘আমার আদরের ভাইকে ৫ মিনিটে লাশে পরিণত করেছে’
সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিম শিপন হত্যার পর এখনো আহাজারি করছেন তাঁর বোন ডা. উম্মে সালমা। ভাইয়ের হত্যার ঘটনা বলতে গিয়ে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বলেন, ‘ওরা পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমার তরতাজা ভাইকে নিথর লাশে পরিণত করেছে।’
গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার শামসুন্নাহারসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা আজ বুধবার এএসপি আনিসুল করিম শিপনের পরিবারকে সমবেদনা জানাতে গাজীপুর শহরের বরুদা এলাকার বাসায় গেলে ডা. সালমা এ কথা বলেন। তিনি রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের গাইনি বিভাগের চিকিৎসক।
ডা. সালমার কথা শুনে পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় উপস্থিত সবার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। পুলিশ সুপার তাদের সান্ত্বনা দেন।
ডা. উম্মে সালমা বলেন, ‘দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আনিসুল করিম শিপন সবার ছোট। সে ছিল পরিবারের সবার আদরের। আমরা কখনো তাকে ফুলের একটি আঁচড়ও লাগতে দেইনি। শিপন ছিল মেধাবী ও সদালাপী এবং বন্ধুবৎসল। সে গাজীপুর জেলা শহরের রাণী বিলাসমনি সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয় থেকে ২০০০ সালে এসএসসি পাস করে। ২০০২ সালে কাজী আজিম উদ্দীন কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের ৩৩তম ব্যাচে লেখাপড়া করে মাস্টার্স সম্পন্ন করে। সে ৩১তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশের চাকরিতে যোগ দেয়। সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম শিপন বরিশাল মহানগর পুলিশে (বিএমপি) সহকারী পুলিশ কমিশনার পদে কর্মরত ছিল।’
ডা. উম্মে সালমা বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে শিপন কিছুটা অসুস্থতা বোধ করছিল। চিকিৎসার জন্য গত সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আমি ও আমার বড় ভাই রেজাউল করিম সবুজ রাজধানীর আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালে শিপনকে নিয়ে যাই। সেখানে ভর্তির ব্যাপারে আমরা নিচতলায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলছিলাম। আমি শিপনকে জুস খাওয়াচ্ছিলাম। এ সময় শিপন টয়লেটে যেতে চায়। হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী টয়লেটে নেওয়ার কথা বলে শিপনকে আমার হাত থেকে দোতলায় নিয়ে যায়। পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যেই এক কর্মচারী এসে আমাকে দোতলায় যেতে বলে। আমি দৌড়ে দোতলায় গিয়ে একটি কক্ষের দরজা বন্ধ দেখতে পাই। আমি ওই কক্ষে প্রবেশ করে মেঝেতে উপুড় হয়ে ভাইয়ের নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখি। সেখানে কেউ ছিল না। সবাই ভাইকে ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে। ভাইয়ের এ অবস্থা দেখে আমি চিৎকার করে ডাক্তারকে ডাকতে থাকি এবং অক্সিজেন সিলিন্ডার ও সাকার মেশিন নিয়ে আসতে বলি। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। অগত্যা আমি নিজেই ভাইয়ের বুকে চাপ দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস সচল করার চেষ্টা করি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এ সময় তার নাক-মুখ দিয়ে পেট থেকে খাবার বের হয়ে আসতে থাকে। এ মর্মান্তিক দৃশ্য না দেখলেই নয়।’
‘আমরা হাসপাতালে ভাইয়ের পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় দিয়েছি। আমরা বলেছি, ওর তেমন কোনো সমস্যা নেই। ওর একটু কমফোর্ট দরকার। অথচ কে জানত যে হাসপাতালে নেওয়ার পর ভর্তির আগেই কয়েক মিনিটের মধ্যেই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমার ভাই সংবাদের শিরোনাম হয়ে উঠবে। এটা আমরা কোনোদিন ভাবি নাই। যাকে আমরা কখনো একটি ফুলের টোকা পর্যন্ত দেইনি, সেই ভাইকে ওরা আমার হাত থেকে নিয়ে নির্যাতন করে পাঁচ মিনিটের মধ্যে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।’
এ সময় সালমার কথা শুনে গাজীপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার কান্নায় ভেঙে পড়েন। উপস্থিত সবার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে। পুলিশ সুপার তাদের সান্ত্বনা দেন।
নিহতের স্ত্রী শারমিন সুলতানা আহাজারি করে বলেন, ‘আমার স্বামীকে সুস্থ করার জন্য আমি হাসপাতালে পাঠিয়েছি। অথচ সেখানে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এমন কেন হলো? এখন আমার ও আমার একমাত্র সন্তানের কী হবে? আমার সন্তানকে এখন কে বাবা বলে আদর করে জড়িয়ে কোলে তুলে নিবে। আমি আমার স্বামীর হত্যার বিচার চাই।’
এ সময়ে মায়ের (শারমিন সুলতানা) পাশে থাকা চার বছরের শিশুসন্তান সাফরান তার বাবা শিপনকে খুঁজছিল।
সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম শিপন বরিশাল মহানগর পুলিশে (বিএমপি) সহকারী পুলিশ কমিশনার পদে কর্মরত ছিলেন। গত সোমবার তাঁকে চিকিৎসার জন্য রাজধানীর আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে হাসপাতালের কর্মচারীদের নির্যাতনে তিনি নিহত হন। তাঁর বাসা গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বরুদা এলাকায়। তবে তাঁদের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার সম্মানিয়া ইউনিয়নের আড়াল গ্রামে। তাঁর স্ত্রী ও সাফরান নামের চার বছরের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে।