‘আমাকে দেখে নারীরা উৎসাহ পাবেন’
বাংলাদেশ কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন উম্মে কুলসুম স্মৃতি। দশম জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক সদস্য ও আইনজীবী উম্মে কুলসুম স্মৃতি ১৯৬৩ সালের ১ জানুয়ারি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার জামালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মরহুম মোকসেদ আলী প্রধান মধু ও মায়ের নাম মরহুমা মাহমুদা বেগম প্রধান।
স্মৃতির স্বামী মো. মাহবুর রহমান একজন ব্যবসায়ী। ছাত্রজীবন থেকেই স্মৃতি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয়। ছাত্রজীবন শেষে একজন আইনজীবী হিসেবে ১৯৯৩ সালে ঢাকা বারে যোগ দেন এবং আওয়ামী রাজনীতি তথা আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত হন। ২০০০ সালে ঢাকা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সর্বাধিক ভোটে কার্যকরী পরিষদের এক নম্বর সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৬-০৭ সালের ঢাকা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে কার্যকরী পরিষদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন, ২০০৩ সালে বাংলাদেশ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে যোগ দেন সাধারণ সদস্য হিসেবে। এরপর আইনবিষয়ক সম্পাদক ও পরে ২০১২ সালে কাউন্সিল অধিবেশনে কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বর্তমান সময়ে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গাইবান্ধা জেলা শাখার সদস্য ও বাংলাদেশ আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য। দশম জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে গাইবান্ধা সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই সংসদে তিনি কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (সিপিএ) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সদস্য।
আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন সময়ে তিনি এপিপি, এডিশনাল পিপি ও পিপি (দুর্নীতি দমন কমিশন) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কলেজজীবনে ভালো কাবাডি খেলোয়াড় ছিলেন স্মৃতি। কাবাডিতে গাইবান্ধা জেলা চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য ছিলেন তিনি।
কৃষকদের অধিকার, কৃষক লীগের আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয় এনটিভি অনলাইনের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এনটিভি অনলাইনের স্টাফ করেসপনডেন্ট ফখরুল শাহীন।
এনটিভি অনলাইন : আপনার সম্পর্কে কিছু বলুন। আপনার পরিবার, ব্যক্তিগত শখ, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে।
উম্মে কুলসুম স্মৃতি : আমি কলেজ লাইফ থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম। আমি পড়তাম গাইবান্ধা সরকারি কলেজে। যখন ‘জয় বাংলা’ মানুষ বলতে পারত না। আশির দশকে যখন ইন্টারে ভর্তি হলাম, তখন থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম। আমি সাধারণত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য ছিলাম। আমি গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে গ্রামে পড়ালেখা করেছিলাম, সেখানে জয় বাংলা বলা বা রাজনীতি, তাও আবার নারীরা, কোনো স্কোপ ছিল না।
এরশাদের শাসন আমলের শুরুর দিকে, আমি যখন ক্লাস সেভেন-এইটে হয়তো পড়ি, তখন ভোট হচ্ছে নৌকা আর লাঙ্গলের, যেহেতু আমাদের ওইখানটা এরশাদের এলাকা আমার নানার বাড়ির লোকজন জাতীয় পার্টি-ঘেঁষা ছিল, সবাই লাঙ্গল নিয়ে মিটিং-মিছিল করত। আমি তখন খুব কান্নাকাটি করে মাকে রাজি করিয়েছি নৌকায় ভোট দেওয়ার জন্য, যদিও আমি তখন বুঝি না তেমন ভালো করে নৌকাটা কী। আমি মা-কে কসম কাটাই ছিলাম আমার গা ছুঁয়ে। মা আমাকে তখন প্রশ্ন করেছিল, নৌকায় ভোট দিলে কী হবে? বিষয়টা হচ্ছে বুঝ হওয়ার আগেই আমি নৌকার প্রতি কেমন যেন একটু দুর্বল ছিলাম।
এনটিভি অনলাইন : আপনি ক্রীড়াবিদ ছিলেন। এখন রাজনীতিতে। পথচলাটা কেমন ছিল?
উম্মে কুলসুম স্মৃতি : ১৯৭৯ সালের কথা। রাজশাহী বিভাগে ইউনিয়ন পর্যায়ে মহিলা কাবাডি খেলার আয়োজন করে। আমি পলাশবাড়ী থেকে খেলতে খেলতে রংপুর গেলাম, তারপর রাজশাহী বিভাগে গেলাম এবং দলনেতা ছিলাম। কিন্তু রাজশাহী থেকে আর ঢাকা যেতে পারিনি। আমি বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলাম। কলেজে পড়ার সময় যত ধরনের খেলাধুলা আছে, সবগুলোতে অংশগ্রহণ করেছি। লং জাম্প, হাই জাম্প, দৌড় প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। তবে এইচএসসি শেষ করে তেমন একটা আর খেলা হয়নি। গ্রামের লোকে কীভাবে নেবে। এসব ভেবেই আর খেলিনি।
বিএসসি পাস করার পরে আমার বাবার এক সহকর্মীর স্ত্রী মহিলা পরিষদের নেত্রী ছিলেন। বাবাকে বলে তিনি আমাকে মহিলা পরিষদের যুক্ত করান। এর পর মহিলা পরিষদ গাইবান্ধা জেলার আহ্বায়ক করেন।
এর মধ্যে আমি আবার এলএলবিতে ভর্তি হলাম। আর আমার যখন বিয়ে হয়ে গেল। আমার স্বামীর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আমি তখন সেখানে চলে যাই। সেখানে আর ওইভাবে রাজনীতি করা হয়নি।
এরপর শুরু করি আইন ব্যবসা। তখন স্বামীর পরামর্শ আর নিজের চেতনায় তখন আওয়ামীপন্থী আইনজীবীদের সঙ্গে বিভিন্ন মিছিল-মিটিং করতাম। তখন দু-চারজন মহিলা আইনজীবী ছিলেন। এরপর আইনজীবী আনোয়ারা আপার সঙ্গে কথা হয়। তাঁর হাত ধরেই আওয়ামী আইজীবী পরিষদের সদস্য হলাম। এরপর বারের নির্বাচনের সময় সাহারা আপার (সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন) সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। এর পর থেকে আপা আমার খোঁজখবর রাখতেন। আপা বলতেন, তুমি প্রতিদিন আমার সঙ্গে একবার এসে দেখা করে যাবা। আমিও তাই করতাম, কোর্টের কাজ শেরেই আপার কাছে যেতামই, বেশির ভাগ দিনে তার সঙ্গে দুপুরের খাবার খেতাম। তিনি আদর করতেন, এর পর আপার মাধ্যমেই বারে আমার একটা পরিচিতি বাড়তে থাকে।
এরপর ২০০৫ সালের দিকে কৃষক লীগের মহিলাদের নিয়ে কিষানি লীগ তৈরি হয়। তখন নেত্রী আমাকে কিষানি লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেন। তখন বারে সাংস্কৃতিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কিষানি লীগটি আর আলোর মুখ দেখাতে পারেনি।
এনটিভি অনলাইন : পরিবার ও সহকর্মীদের কাছ থেকে কেমন সমর্থন পেয়েছেন?
উম্মে কুলসুম স্মৃতি : পরিবার ও সহকর্মীরা আমাকে যথেষ্ট সাপোর্ট দিয়েছিল। আমাকে আমার মেয়েরা কখনই কাজে বিরক্ত করেনি। ওদের বাবা সব সময় আমাকে সাপোর্ট দিত যেন আমি ভালো করে কাজ করতে পারি। আমার বাসায় গৃহকর্মীরাও সাহায্য করত।
এনটিভি অনলাইন : বাংলাদেশে নারী হয়ে রাজনীতি করাটা কি আগের মতোই কঠিন? নাকি গত ১০ বছরে পরিস্থিতি বদলেছে?
উম্মে কুলসুম স্মৃতি : আগের মতো নেই। অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছ। নারীরা প্রতিটা জায়গায় এগিয়ে আছে, তাদের নিজ নিজ দক্ষতায় আসছে। তবে অনুপ্রেরণায় ছিলেন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তার পরও পুরুষশাসিত সমাজ তো, তাই এখনো ডমিনেট করেতে চায়। তবে নারীদের রাজনীতিতে আসা, পারিবারিক বিষয়ে, তাদের অধিকার নিয়েও তারা এখন অনেক সচেতন। এবং এটা আরো পরিবর্তন হবে। বিশেষ করে আমাকে দেখে যারা কিষানি উদ্বুদ্ধ হবে, নারীরা উৎসাহ পাবে।
এনটিভি অনলাইন : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে কেমন সমর্থন পেয়েছেন?
উম্মে কুলসুম স্মৃতি : প্রধানমন্ত্রী আমাকে খুব আদর করেন। তিনি চেয়েছেন বলেই আমি এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। তিনি আমাকে এত বড় একটা অবস্থান দিয়েছেন। আমি চেষ্টা করব যে এ পজিশনটাকে ব্যবহার করার জন্য, অপব্যবহার না করার জন্য। আমি চেষ্টা করব আমার ভুলটা যেন কম হয়। যদিও মানুষমাত্রই ভুল হয়।
এনটিভি অনলাইন : বাধাগুলো কী কী ছিল যদি বলতেন?
উম্মে কুলসুম স্মৃতি : কমিটিতে স্পেস দিত না, নারী বলে অনেক কিছুতেই আমাদের অযোগ্য মনে করা হতো। আমি যখন জয়েন সেক্রেটারি হতে চেয়েছিলাম, তখন আমি প্রায় প্রতিটি সাংগঠনিক জেলা সফর করেছি নিজ ইচ্ছা থেকে। সেটা প্রায় ৭০টি জেলায়। আবার যখন ওকালতি করতে যাই, তখন আমার চাচাশ্বশুর মুখের ওপর বলে দিয়েছেন—বউ, মানুষের ওকালতি করা লাগবে না।
আমার রাজনীতিতে যারা সমসাময়িক ছিল, তারা চাইত না, আবার যারা জুনিয়র, তারাও চাইত না আমি এগিয়ে যাই। তবে উকিল হওয়া মুখটা বেশি চলত, তাই কেউ পেরে উঠত না। আর ওদের ডমিনেট করতে পেরেছি বলে আজ আমি সাধারণ সম্পাদক। আমার স্বামী সব সময় বলে, আমি সাহসের লক্ষ্মী। ও তুমি সাহস করে যেতে থাকবা, যা আছে কপালে।
এনটিভি অনলাইন : কৃষক লীগ নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী? মাঠের কৃষকদের কথাবার্তা, দাবি-দাওয়া কি যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারবেন?
উম্মে কুলসুম স্মৃতি : কৃষকের জন্য প্রধানমন্ত্রী যতটুকু দেন, ততটুকু যদি আমার কৃষকেরা পায়, তাহলে কৃষকের কোনো দুঃখ থাকবে না। নেত্রী একা চেষ্টা করছে, আমরা কর্মীরা যদি ঠিক থাকি, তাহলে মনে হয় এটা সম্ভব। আমি সেটা চেষ্টা করব।
আমি ২০০৩ সাল থেকেই কৃষকদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। কৃষকদের নিয়ে কৃষক লীগ কাজ করে। যেমন ধানের দামের বিষয়ে আমি উপজেলা নির্বাহীর সঙ্গে কথা বলেছি। কৃষিকার্ডে বিষয়ে যে ঝামেলা আছে, কৃষকের যে ধানটা আছে, সেগুলো কীভাবে কৃষক থেকে কেনা যায়, প্রকৃত কৃষকেরা আছে কি না এগুলো নিয়ে আমি কাজ করেছি। কৃষক লীগের সবাই প্রশাসনকে সহায়তা করবে। আমি আশা করি, কৃষকের মুখে হাসি ফুটবে।
এনটিভি অনলাইন : বিদেশে কৃষক লীগের শাখা কমিটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এমনকি ঢাকাসহ বিভিন্ন মহানগরে এর কমিটি থাকার প্রয়োজন আছে কি?
উম্মে কুলসুম স্মৃতি : সচিবালয়, মন্ত্রণালয় সবকিছু কিন্তু ঢাকায়। কৃষকের কথা তো ঢাকায় বলতে হবে। আমি কোথায় বলব? গ্রামেই বললে কথাটা কীভাবে পৌঁছাবে? রাজপথে থাকার জন্যই এ সংগঠনের ঢাকায় থাকা প্রয়োজন রয়েছে।শক্তিশালী সংগঠনের প্রয়োজন আছে।
বিদেশি শাখার বিষয়টা আমাদের গঠনতন্ত্রে আছে। সেহেতু আমরা করতে পারি। তা থাকার ব্যপারে যুক্তিটা হলো বিদেশ থেকে ভালো বীজ আসে, কৃষি যন্ত্রাংশ আসে। কৃষিটাকে আমরা যান্ত্রিকীকরণ করার চেষ্টা করছি, ডিজিটাল ব্যবস্থা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি।
এনটিভি অনলাইন : একসময় ক্রীড়াবিদ ছিলেন। আগামী দিনে খেলা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
উম্মে কুলসুম স্মৃতি : আমি চাইব কৃষকের ছেলেমেয়েরা যেন খেলাধুলায় আসুক। এটার জন্য উৎসাহ দেব। কৃষকের ছেলেমেয়েরা এখন বই পায়, স্কুলের পোশাকও পাবে।