অল্প পরিসর, স্বল্প পুঁজি, মাছের উৎপাদন তিন গুণ বেশি
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষে ঝুঁকছেন কিশোরগঞ্জের ভৈরবের তরুণ মৎস্যচাষিরা। বাড়ির উঠান, বাসার ছাদ বা ফসল হয় না এমন পরিত্যক্ত ভূমি ব্যবহার করে অল্প পরিসর ও স্বল্প পুঁজিতে কমপক্ষে তিন গুণ বেশি মাছ উৎপাদনের আধুনিক এই নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হওয়ায় লাভবান হচ্ছেন প্রকল্প গ্রহণকারীরা। ফলে একের সাফল্যে অন্যরা পদ্ধতিটি গ্রহণ করায় এলাকায় বাড়ছে এর পরিধি। এতে করে স্থানীয়ভাবে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ অধিক মুনাফা লাভ এবং বেকারত্ব দূর করার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
বায়োফ্লক পদ্ধতি কী? বায়োফ্লক হলো প্রোটিনসমৃদ্ধ জৈব পদার্থ ও অণুজীব (ব্যাকটেরিয়া, ডায়াটম, প্রোটোজোয়া, অ্যালজি), অব্যবহৃত খাদ্য, মাছের মল, অন্যান্য অমেরুদণ্ডী ও মৃত প্রাণীর দল (এগ্রিগেশন)। এটি মূলত প্রোটিন, পলিস্যাকারাইড, হিউমিক পদার্থ, নিউক্লিক এসিড ও লিপিডের সমন্বয়ে গঠিত। বায়োফ্লক প্রযুক্তির উপকারী ব্যাকটেরিয়া মাছের অব্যবহৃত খাদ্য, মলমূত্র থেকে নিঃসৃত অ্যামোনিয়া ও বায়োফ্লক সিস্টেমে সরবরাহকৃত কার্বনকে ব্যবহার করে অণুজীব প্রোটিন (আমিষ) তৈরি করা।
খাবারের মাত্র ২৫ শতাংশ প্রোটিন মাছের দেহে কাজে লাগে। বাকি অংশ পানিতে অব্যবহৃত থেকে যায়। বায়োফ্লক প্রযুক্তিতে এই অব্যবহৃত প্রোটিন মাইক্রোবিয়াল প্রোটিনে রূপান্তর হওয়ায় প্রোটিন রিকভারি দ্বিগুণ হয়ে যায়। এই প্রযুক্তি পানিতে বিদ্যমান কার্বন ও নাইট্রোজেনের সাম্যাবস্থা নিশ্চিত করে পানির গুণাগুণ বৃদ্ধি ও ক্ষতিকর রোগ সৃষ্টিকারী নিয়ন্ত্রণ করে। বায়োফ্লক প্রযুক্তিতে হেটারোট্রপিক ব্যাকটেরিয়া নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য গ্রহণ করে মাইক্রোবিয়াল রূপান্তর করে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের জনসংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় অন্যান্য চাহিদার সঙ্গে বাড়ছে খাদ্য-পুষ্টির চাহিদাও। এর মধ্যে অন্যতম খাদ্য ও পুষ্টির অনুষঙ্গ হলো মাছ। এই বাড়তি জনসংখ্যার মাছ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য উৎপাদনকারী খাতের সম্প্রসারণ প্রয়োজন। কিন্তু দিনে দিনে প্রাকৃতিক পানির উৎস নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুরসহ বিভিন্ন জলাভূমি কমে যাওয়ায় কমে যাচ্ছে প্রাকৃতিক মাছের উৎস।
এতে করে উৎপাদনশীলতা, সঠিক গুণাগুণ, লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার, বায়োসিকিউরিটি নিশ্চিতকরণ এবং বাজারের চাহিদামতো মাছ সরবরাহসহ সব ক্ষেত্রে দক্ষতার সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহার সুনিশ্চিতকরণের প্রয়োজনে মাছ চাষ প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতার সম্মুখ হচ্ছে।
পানি ও মাটি উল্লেখযোগ্যভাবে কম ব্যবহারের মাধ্যমে অধিক পরিমাণে মাছ উৎপাদন, অ্যাকোয়াকালচার পদ্ধতির উন্নতি সাধন, পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব দূরীকরণ, মাছ চাষের খরচ হ্রাস এবং লাভের অনুপাত বৃদ্ধিকরণ। টেকসই অ্যাকোয়াকালচারের লক্ষ্য পূরণে বায়োফ্লক পদ্ধতি অন্যতম। বায়োফ্লক পদ্ধতি ব্যবহার করে অল্প পরিসরে অধিক পরিমাণ মাছ উৎপাদন সম্ভব। যা বাংলাদেশ সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছচাষের প্রশিক্ষক ও বিশেষজ্ঞ মো. সামছু উদ্দিনের মতে, বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছের চাষ একটি টেকসই এবং পরিবেশগতভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ মাছচাষ পদ্ধতি। এটি একটি পরিবেশবান্ধব ও পুরোপুরি নিরাপদ পুষ্টিসমৃদ্ধ মাছ উৎপাদন পদ্ধতি। যে পদ্ধতিতে মাছের ত্যাগ করা মলকে তার খাদ্যে রূপান্তর করা হয়। ফলে ২৫ শতাংশ খাবারে শতভাগ চাহিদা পূরণ হয়। এতে করে মাছ উৎপাদনে খাদ্য খরচ শতকরা ৭৫ ভাগ কম হয়। অপরদিকে এই পদ্ধতিতে পুকুরে চাষ করা পদ্ধতির চেয়ে অল্প জায়গায় তিন গুণ বেশি মাছ উৎপাদন হয়।
বাড়ির আঙিনায়, বাসার ছাদে অথবা ফসল হয় না এমন অনুর্বর ভূমিতে বায়োফ্লক প্রকল্প গ্রহণ করা যায়। সিমেন্ট, রড বা ড্রামের চৌবাচ্চা, বাজারের প্রচলিত পানির ট্যাংকি এবং জমি থেকে তিন-চার ফুট মাটি তুলে আইল বেঁধে পলিথিনের ত্রিপাল নিচে দিয়ে পানির আধার তৈরি করে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে তেলাপিয়া, রুই, শিং, মাগুর, পাবদা, গুলশা ও চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করা যায়।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষে সফল চাষি রায়হান মিয়া, মনিরুজ্জামান ও মোহাম্মদ আলী জানান, বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছের চাষ হলো অল্প পুঁজিতে বেশি লাভের একটি পদ্ধতি, যা গ্রহণ করে যে কেউ লাভবান হতে পারেন। এখানে যেহেতু মাছের বর্জ্য থেকে আবার খাবার তৈরি হয়, তাই ২৫ ভাগ খাদ্যে শতভাগ মাছ উৎপাদন করা যায়। তাঁদের মতে, প্রথম অবস্থায় এক লাখ টাকা খরচ করে কেউ ১০ হাজার লিটার পানির একটি বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করলে, তার ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা লাভ হবে। পরে তার মাছ ও খাবার ছাড়া অন্যান্য বিনিয়োগ না হওয়ায় লাভের অঙ্কটা আরো বেশি হয়। এই হিসাবে যিনি যত বড় পানির আধার তৈরি করবেন, তার তত বেশি লাভ হবে। মাছের উৎপাদনের পরিমাণও বেশি হবে।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছচাষকে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উল্লেখ করে তাঁরা আরো জানান, পুকুরে মাছ চাষ করলে কিছু না কিছু ওষুধ দিতে হয়। এতে করে মাছের প্রাকৃতিক গুণাগুণ অক্ষুণ্ণ হয়ে অনিরাপদ হয়ে ওঠে। কিন্তু বায়োফ্লক পদ্ধতিতে ওষুধ প্রয়োগ করতে হয় না বলে এটি থাকে অত্যন্ত নিরাপদ ও প্রাকৃতিক। সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন।
চাকরির পেছনে না ছুটে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত তরুণ/ তরুণীরা এই পদ্ধতি গ্রহণ করে বেকারত্ব দূরসহ লাভবান হতে পারেন বলে অভিমত তাদের। এ ছাড়া এই পদ্ধতিতে মাছের চাষ প্রকল্প গ্রহণ করে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ দেশের অর্থনীতিতে রাখতে পারেন অবদান। তাঁদের অভিমত, সরকারি সহায়তায় যদি ভৈরবের মতো সারা দেশে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছের চাষ ছড়িয়ে দেওয়া গেলে মাছ উৎপাদনে বর্তমানে বিশ্বের চতুর্থ স্থান থেকে বাংলাদেশ প্রথম বা দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসবে।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তথ্য পেয়ে ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে ভৈরবের বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছচাষিদের কাছে প্রায় প্রতিদিন আসছেন আগ্রহী তরুণ-তরুণীরা। তাঁরা বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছের চাষ করে সফল হওয়া মৎস্যচাষিদের প্রকল্প সরেজমিনে দেখছেন। কথা হয় তেমন কয়েকজনের সঙ্গে।
এ বিষয়ে ঢাকার গুলশানের রাজীব, পুরান ঢাকার শরফুদ্দিন ও নেত্রকোনার কানাই দাস জানান, তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে রায়হান আর মনিরুজ্জামানের অ্যাকাউন্টে এই পদ্ধতির মাছের চাষ বিষয়ে জানেন।
নরসিংদীর রায়পুরার বিলকিছ আহমেদ জানান, তিনি মনিরুজ্জানের সঙ্গে একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালায় পরিচিত হন। এখন তিনি সেটি সরেজমিনে দেখতে এবং অভিজ্ঞতা বিনিময় করে হাতে-কলমে জ্ঞান লাভে এখানে এসেছেন। তাঁরা সবাই নিজ নিজ এলাকায় প্রকল্পটি গ্রহণ করবেন বলে জানান।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছচাষে ভৈরবে ব্যাপক সম্ভবনা রয়েছে বলে জানিয়ে ভৈরবের সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. লতিফুর রহমান জানান, যেহেতু ভৈরবে পুকুরের সংখ্যা কম, তাই এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে এখানকার চাষিরা লাভবান হতে পারেন। এই পদ্ধতিতে এক ভাগ খাদ্য দিয়ে তিন গুণ মাছ পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ইতোমধ্যে এখানকার মৎস্যচাষিদের মাছে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে এই পদ্ধতির মাছের চাষ। আর চাষিদের এই চাষ বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে তুলতে এরই মধ্যে ৫০জন চাষিকে বায়োফ্লক পদ্ধতির ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আগ্রহী আরো ৩০ জন তাদের নামের তালিকা জমা দিয়ে গেছেন প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য। এ ছাড়া ইতোমধ্যে এখানকার ৫০ জন মাছের চাষিকে সরকারি খরচে পাশের একটি জেলায় সফর করিয়ে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছের চাষ বিষয়ে সম্যকজ্ঞান দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে এনটিপি-২ প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে একজন বায়োফ্লক পদ্ধতির মাছের চাষিকে সাড়ে তিন লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে জানিয়ে লতিফুর রহমান জানান, আরো দুটি অনুদান অনুমোদনের অপেক্ষায়। যাঁরাই এই পদ্ধতিতে মাছের চাষে আগ্রহী হবেন, তাঁদের অনুরূপ বিভিন্ন সহায়তা তাঁর দপ্তর করবে।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছের চাষ জনপ্রিয়তা পাওয়ায় এরই মধ্যে ভৈরবে ক্যাটফিশ জাতীয়, অর্থাৎ তেলাপিয়া, রুই, শিং, মাগুর, পাবদা, গুলশা ও চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও জানান ভৈরবের সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা, যা খুবই আশাব্যঞ্জক বলে তাঁর অভিমত।