অভিমানে বিবাগি, ঘরে ফিরতে বাধ্য হলেন ব্যবসায়ী
একটি বেসরকারি ব্যাংকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন আকাশ চৌধুরী। লক্ষাধিক টাকা বেতনের চাকরি। সেই ব্যাংকে কর্মরত থাকাকালে ২০১১ সালে হজে যান আকাশ। হজ পালন শেষে তিনি ভাবলেন, ব্যাংকে সুদের কারবার হয়। ফলে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন।
চাকরি ছাড়ার পর নামাজ-কালাম আর পরিবার নিয়ে সময় কাটাতেন আকাশ চৌধুরী। এভাবেই চলছিল। এরপর ২০১৩ সালে একপর্যায়ে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের একটি গ্রামে গড়ে তোলেন মুরগির খামার। পাঁচ হাজার মুরগি পালন দিয়ে শুরু করেন খামারের কার্যক্রম।
একইসঙ্গে খামার থেকে পাওয়া ডিম দিয়ে শুরু হয় ডিমের ব্যবসা। এভাবেই চলতে শুরু করল। ব্যবসায় সফলতা এলো সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। বেশ ভালোই দিন কাটছিল আকাশের। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত তিনি ছিলেন পুরোদস্তুর একজন ব্যবসায়ী।
২০২১ সালের ২ মে। আকাশ চৌধুরী তাঁর পরিবারকে জানান, ব্যাংকে টাকা জমা দিতে যেতে হবে। বাসা থেকে আড়াই লাখ টাকা নিয়ে বের হন তিনি। এরপর রাজধানীর মিরপুরের তিনটি মার্কেটের তিনজন ডিম ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পাওনা বাবদ ৬৪ হাজার ১০০ টাকা সংগ্রহ করেন। এরপরই বন্ধ হয়ে যায় আকাশ চৌধুরীর মুঠোফোন।
আকাশ চৌধুরী যখন বাসায় ফিরছিলেন না, চিন্তিত হয়ে পড়ে তাঁর পরিবার। চারিদিকে খোঁজাখুঁজির পরও না পেয়ে তাঁর স্ত্রী অনীতি বেগম ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিরপুর মডেল থানায় স্বামীকে ছিনতাই শেষে অপহরণ করা হতে পারে আশঙ্কা করে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। তদন্ত শুরু করেন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. খোকন মিয়া।
তদন্তে নেমে খোকন মিয়া মিরপুর এলাকার বেশ কিছু সিসি ক্যামেরার ছবি ও ফুটেজ দেখেন। কিন্তু, ক্যামেরায় আকাশকে যতদূর দেখা গেছে, কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা চোখে পড়েনি। আকাশের বন্ধুস্থানীয় এক ডিম ব্যবসায়ী পুলিশকে জানিয়েছেন, তিনি রিকশা ঠিক করে দেওয়ার পর মিরপুর-১ নম্বর গোল চত্বরের দিকে রওনা হন আকাশ। কিন্তু পুলিশের ধারণা, ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটতে পারে। এর আগেও একবার আকাশের কাছ থাকে অনেক টাকা ছিনতাই হয়েছিল।
তদন্তে নেমে আকাশের ফোন ট্র্যাকিং করছিল পুলিশ। প্রযুক্তির সহায়তায় পুলিশ জানতে পারে, ৩০ এপ্রিল আশুলিয়ায় ছিলেন আকাশ। ৫ মে সন্ধ্যা। হঠাৎ জানা যায়, আকাশের কাছে থাকা মুফোঠোনে একটি সিম অন করা হয় আশুলিয়া থেকে। সে সময় একটি নম্বরে মাত্র ১৯ সেকেন্ড কথা বলে আবার ফোনটি বন্ধ করে রাখা হয়।
পরবর্তী সময়ে ১৯ সেকেন্ড কথা বলা ওই নম্বরের ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে পুলিশ। জানা যায়, ওই ব্যক্তি একজন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক। নাম মহিউদ্দিন। কিন্তু, মহিউদ্দিন সহযোগিতা না করে পুলিশের ফোন নম্বর ব্লক লিস্টে রেখে দেন। কিন্তু, দমে যায়নি পুলিশ। অন্যভাবে মহিউদ্দিনের অবস্থান শনাক্ত করে তাঁকে আটক করে পুলিশ।
মহিউদ্দিন জেরার মুখে পুলিশকে জানাতে বাধ্য হন, আকাশকে তিনি আশুলিয়ার চাঁনগাও খেজুরবাগান এলাকায় আড়াই হাজার টাকায় একটি টিনশেডের ঘর ভাড়া করে দেন। আর, পৌনে দুই লাখ টাকা দিয়ে কিনে দেন একটি ব্যাটারিচালিক অটোরিকশা। ওই অটোরিকশা চালাতে শুরু করেন আকাশ। কিন্তু, বেশি কষ্ট হওয়ায় পরে সেটি ভাড়ায় দিয়ে দেন। এরপর শুরু করেন খুচরা মাছ বিক্রি। এরপর ৮ মে খেজুরবাগান মাছের বাজার থেকে মাছ বিক্রি করা অবস্থায় আকাশকে উদ্ধার করে পুলিশ।
আকাশকে নিয়ে এসআই খোকন মিয়া মিরপুর মডেল থানায় চলে আসেন। খবর দেন স্ত্রী অনীতিকে। থানায় উপস্থিত ছিলেন পুলিশের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। দুই মেয়েকে নিয়ে অনীতি বেগম হাজির হন থানায়। কিন্তু, আকাশ চৌধুরী তাঁর পরিবারের সদস্যদের না চেনার ভান করেন। কেন বাসা ছেড়ে গেলেন তার কোনো জবাবও ঠিকমতো দিচ্ছিলেন না। তাঁর কথাবার্তাও ছিল এলোমেলো। পরবর্তীকালে আকাশের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে থানায় ডাকে পুলিশ।
এ ভাবে আকাশের বন্ধু ও পরিচিতজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনেক তথ্য সংগ্রহ করে পুলিশ। পুলিশ জানতে পারে, ২০২১ সালের মার্চে করোনায় আক্রান্ত হন আকাশ চৌধুরী। সে সময় এক মাস তিনি নিজের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে নিভৃতবাসে ছিলেন। কিন্তু, সে সময় স্ত্রী-সন্তানেরা তাঁকে যথাযথ সময় দেয়নি বলে অবজ্ঞার অভিযোগ তোলেন আকাশ।
আকাশ চৌধুরীর আক্ষেপ, তিনি যখন মৃতপ্রায়, তখন ভালোমতো তাঁর দেখভাল করেনি পরিবার। করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পর আকাশ ওই এক মাসের কথা বার বার ভাবতেন। সে সময়ের কথা ভুলতে পারতেন না। তাঁর মনে হতো, যে পরিবারের জন্য লাখ লাখ টাকা উপার্জন করেছেন, সেই পরিবারের লোকজন তাঁকে অবজ্ঞা করেছে। অথচ, বরিশাল শহরে আকাশ বাড়ি করেছেন, কিনেছেন গাড়িও। ঢাকায় ফ্ল্যাট তো আছেই। এসব ভাবতে ভাবতেই সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলেন আকাশ—এই সংসারে তিনি আর থাকবেন না। নিজের মতো করে বাঁচবেন, গৃহত্যাগী হবেন। বাড়ি ছাড়ার আগে এসব আক্ষেপের কথা আকাশ তাঁর বন্ধুকে জানিয়েছিলেন।
মনে একরাশ কষ্ট ও অভিমান নিয়ে আকাশ চৌধুরী ২ মে গৃহত্যাগ করেন। তিন লাখ ৩৬ হাজার ৬০০ টাকা নিয়ে বের হয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন সবার সঙ্গে।
নিজের অজ্ঞাতবাস প্রকাশ হওয়ার পর আকাশ এসআই খোকন মিয়াকে বলেছিলেন, ‘আমি আর বাসায় ফিরব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তাই স্ত্রী-সন্তানদের না চেনার ভান করেছি। আমার মনে অনেক কষ্ট। আমার মনে হয়েছে, আমার আপন কেবল আমিই।’
সবকিছু স্বীকার করার পর পুলিশ আকাশকে তাঁর পরিবারের হাতে তুলে দেয়। গতকাল শনিবার রাতে এসআই খোকন মিয়া এই প্রতিবেদককে পুরো ঘটনাটি জানান। পরে পরিবারের বক্তব্য জানতে অনীতির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে ফোনের লাইনটি কেটে দেন।
(ওপরের ঘটনার বর্ণনায় এসআই খোকন মিয়া ছাড়া সঙ্গত কারণে অন্যদের ক্ষেত্রে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।)