অবসরে তাস খেলার অপরাধে এত বড় শাস্তি!
গোপালগঞ্জে পুলিশের এক সহকারী উপপরিদর্শকের (এএসআই) মারধরে নিখিল তালুকদার (৩২) নামের এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বুধবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মারা যান তিনি।
নিখিল তালুকদার কোটালীপাড়া উপজেলার রামশীল গ্রামের নীলকান্ত তালুকদারের ছেলে। তিনি কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাঁর দুই শিশুসন্তান রয়েছে।
এদিকে, নিখিলের মৃত্যুতে তাঁর পরিবারে শোক চলছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তাঁর স্ত্রী ইতি তালুকদার চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন। ছেলে নিবিড় তালুকদার (১) ও মেয়ে নিশিতা তালুকদারের (৭) ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন ইতি। এ ছাড়া নিখিলের বাবা সম্প্রতি হার্টের অপারেশন করিয়েছেন। ছেলের মৃত্যুর ঘটনায় মুষড়ে পড়েছেন তিনিও।
নিখিলের স্ত্রী ইতি তালুকদার জানান, তাঁদের জমির ধানকাটা ও ধান গোলায় তোলা হয়েছে। কাজ ছিল না, তাই অবসর সময় কাটাচ্ছিলেন নিখিল। গত মঙ্গলবার বিকেলে রামশীল বাজারের ব্রিজের পূর্ব পাশে নিখিলসহ চারজন বসে সময় কাটানোর জন্য তাস খেলছিলেন। এ সময় কোটালীপাড়া থানার এএসআই শামীম উদ্দিন একজন ভ্যানচালক ও এক যুবককে নিয়ে সেখানে যান। তারপর গোপনে মুঠোফোনে তাস খেলার দৃশ্য ধারণ করেন। তাঁরা বিষয়টি টের পেয়ে খেলা রেখে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। এ সময় অন্য তিনজন পালিয়ে গেলেও নিখিলকে ধরে মারধর শুরু করেন এএসআই শামীম উদ্দিন। একপর্যায়ে হাঁটু দিয়ে নিখিলের মেরুদণ্ডে আঘাত করেন শামীম। এতে নিখিলের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। পরে তাঁকে প্রথমে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তাঁর অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসক ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে পাঠাতে বলেন। সেখানে গত বুধবার বিকেলে মারা যান নিখিল।
ইতি তালুকদার বলেন, ‘আমার স্বামী কী অপরাধ করেছে? তাঁকে এভাবে কেন মেরে ফেলা হলো? আমার এক বছরের ছেলে নিবিড় তালুকদার ও মেয়ে নিশিতা তালুকদার—এদের ভবিষ্যৎ কী হবে? তা ছাড়া আমার শ্বশুরের কয়দিন আগে হার্টের অপারেশন করা হয়েছে। ছেলের শোকে তাঁকে বাঁচানো কঠিন হবে। স্বামীকে হারিয়ে আমি এখন দিশেহারা। আমি এ ঘটনার বিচার চাই।’
নিখিল তালুকদারের চাচাতো ভাই মিলন তালুকদার বলেন, ‘আমার ভাই তাস খেলেছে। এ জন্য পুলিশের এএসআই শামীম হাঁটু দিয়ে আঘাত করে তাঁর মেরুদণ্ড ভেঙে তিন খণ্ড করে ফেলেছে। তিনি যদি কোনো অন্যায় করেন, তাহলে আইন অনুযায়ী তাঁর সাজা হবে। কিন্তু সামান্য তাস খেলার অপরাধে একজন এএসআই আমার ভাইকে এভাবে আঘাত করেছে, তার আঘাতেই নিখিলের মৃত্যু হয়েছে। নিখিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁর ওপর একটা সংসার চলে। এখন ওই পরিবারের কী হবে? প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা এর সঠিক বিচার চাই।’
এ ব্যাপারে রামশীল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান খোকন বালা বলেন, ‘নিখিল এলাকার সবার কাছে ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিত ছিল। এলাকার মানুষের কাছে জানতে পারি, কোটালীপাড়া থানার এএসআই শামীম উদ্দিন হাঁটু দিয়ে তাঁর পিঠে আঘাত করেন। এতে নিখিলের মেরুদণ্ড তিন খণ্ড হয়ে যায়, যা পরে এক্স-রের মাধ্যমে জানা গেছে। তাঁকে বরিশাল মেডিকেল রাখেনি, ঢাকায় নেওয়া হলে তাঁর মৃত্যু হয়। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক, একজন আইনের লোক হয়ে বেআইনি কাজ করেছে। তাও আবার মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। তাহলে জনগণ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোটালীপাড়া থানার এএসআই মো. শামীম উদ্দিন মুঠোফোনে বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছুই বলব না। আপনি ওসি স্যারের সঙ্গে কথা বলেন। এ ব্যাপারে ওসি স্যার বক্তব্য দেবেন। কারণ, বিষয়টি ওসি স্যার দেখছেন।’
কোটালীপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ লুৎফর রহমান বলেন, ‘নিখিলকে পুলিশ মারধর করেনি। সে দৌড়ে পালানোর সময় গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়ে কোমরে ব্যথা পেয়েছিল। তারপর শুনেছি, তাঁর নাকি হাড় ভেঙেছিল।’ তবে কী ধরনের গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগেছে, তা তিনি জানাতে পারেননি।
গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মুহাম্মদ সাইদুর রহমান খান বলেন, ‘কোটালীপাড়ার রামশীলে কয়েকজন লোক জুয়া খেলছিল। পুলিশ দেখে ফেললে পালানোর সময় পড়ে গিয়ে একজন আহত হন। প্রথমে তাঁকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে তিনি ঢাকায় মারা যান। কী কারণে তিনি মারা গেছেন, সেটা চিকিৎসকরা বলতে পারবেন। আমরা এটা বলতে পারি না। তবে আমাদের কাছে এমন কোনো অভিযোগ আসেনি যে তাঁকে পুলিশ মেরেছে।’
এএসআই মো. শামীম উদ্দিন এর আগে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানা ও কাশিয়ানী উপজেলার রামদিয়া পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত ছিলেন। সেখানেও তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে।
কাশিয়ানী উপজেলার রাজপাট গ্রামের বাসিন্দা ও ইউপি সদস্য ইরান খন্দকার বলেন, ‘একজন ভ্যানচালককে মাদক ক্রেতা সাজিয়ে আমাদের এলাকার নাজমুল নামের এক ব্যবসায়ীকে মাদক দিয়ে ফাঁসাতে চেয়েছিলেন এএসআই শামীম। এ সময় জনগণের হাতে ধরা খান ওই ভ্যানচালক। পরে তোপের মুখে সব সত্য বলে দেন ভ্যানচালক। এ ছাড়া পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বরাবর শামীমের বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারিসহ আগে থেকেই একাধিক অভিযোগ রয়েছে বলে জানান ইউপি সদস্য।