অপ্রয়োজনে ডেক্সামেথাসন সেবনে হতে পারে মৃত্যু
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জীবন রক্ষায় ডেক্সামেথাসন নামের একটি সস্তা ও সহজলভ্য ওষুধ কাজে আসছে বলে দাবি করছেন যুক্তরাজ্যের গবেষকরা। করোনা প্রতিরোধে স্বল্পমাত্রার এই স্টেরয়েড চিকিৎসা একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার বলে মনে করছেন তাঁরা। তবে বিশেষজ্ঞরা সাবধান করে দিয়ে বলেছেন, এই ওষুধ অহেতুক সেবনে হতে পারে মৃত্যু। তাই এ ওষুধ হাসপাতালে ব্যবহার ছাড়া কিনে বাড়িতে নেওয়া যাবে না।
এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোসাদ্দেক হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত করোনা রোগীকে সুস্থ করে তুলবে এমন কোন ওষুধ তৈরি হয়নি। তবে ডেক্সামেথাসন ওষুধ শুধুমাত্র আইসিইউতে বা শ্বাসকষ্টের কারণে খুব খারাপ পরিস্থিতি হলে তখন ব্যবহার করা হয়। এটি করোনা আক্রান্ত সাধারণ রোগীদের ব্যবহারযোগ্য নয়।’
অপরদিকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. নাজমুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ডেক্সামেথাসন ওষুধ অনেক আগে থেকেই দেশে ব্যবহার হয়ে আসছে। এ ওষুধ বিভিন্ন রোগের জন্য দেওয়া হয়। তবে এ ওষুধের সঠিক প্রয়োগ ও সেবনের পরিমাণ না জানলে রোগীর মৃত্যু হতে পারে । তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এই ওষুধ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।’
ডা. নাজমুল আরো বলেন, করোনায় যাদের সাধারণ উপসর্গ (মাইল্ড) রয়েছে তাদের এই ওষুধ খাওয়ালে হিতে বিপরীত হতে পারে। শুধুমাত্র যাদের ভেন্টিলেটর প্রয়োজন ও খুবই অসুস্থ রোগী তাদের এই ওষুধ প্রয়োগ করে সুস্থ করা যায়। তবে সুস্থ ব্যক্তি এই ওষুধ সেবন করলে তাহলে তাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং সেই ব্যক্তি পরবর্তী সময়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে, তিনি খুব দ্রুত অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারেন।
এই চিকিৎসক আরো বলেন, ‘ডেক্সামেথাসন ওষুধ শুধু মুমূর্ষু রোগীদের দেওয়া হয়ে থাকে। এটি চিকিৎসার শেষ চেষ্টা বলা হয়ে থাকে। এ ছাড়া এই ওষুধে অনেক ধরনের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এর মধ্যে কিডনির সমস্যা, হার্টের সমস্যা, শরীর ফুলে যাওয়া, মোটা হয়ে যাওয়াসহ একাধিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তাই একটাই পরামর্শ চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতিত এই ওষুধ সেবন না করাই শ্রেয়।’
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডাক্তার এ বি এম আব্দুল্লাহ এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, এই ওষুধের অনেক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া আছে। এই ব্যাপারে কিন্তু খুবই সর্তক হতে হবে। অনেক কিছু হতে পারে। এর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় শরীর ফুলে যায়, পুশিং সিনড্রম হয়, ডায়াবেটিস হতে পারে, প্রেশার হতে পারে, আলসার হতে পারে, হাড় ক্ষয় হতে পারে, হার্টে সমস্যা হতে পারে, কিডনি সমস্যা হতে পারে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এটা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোনোভাবে ব্যবহার করা যাবে না।
ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ আরো বলেন, এটা একটা ইমার্জেন্সি ড্রাগ, লাইফ সেভিং ড্রাগ, এটা ঠিক। আমিও কিছু কিছু রোগীকে দিয়েছি। কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে উপকার হয়েছে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, রোগীরা যেন ইচ্ছেমতো দোকান থেকে, ফার্মেসি থেকে কিনে না গ্রহণ করেন। এটা সহজলভ্য ওষুধ। তিনি বলেন, ‘রোগীদের ক্ষেত্রে আমার অনুরোধ, আপনারা নিজেরা খাবেন না, ফার্মাসিস্ট যারা ওষুধ বিক্রি করেন তাদের কাছেও অনুরোধ, তারা যেন কোনোক্রমে প্রেসক্রিপশন ছাড়া এই ওষুধ বিক্রি না করেন এবং রোগীরা নিজেরা কিনে খাবেন না। কারণ মিসইউজ হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি।’
ডেক্সামেথাসন রিউমাটয়েড আথ্রাইটিস এবং অ্যাজমার মতো বিভিন্ন রোগে গুরুতর পর্যায়ে ডেক্সামেথাসন ১৯৬০ সালের শুরু থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
এর আগে গতকাল ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভেন্টিলেটারে থাকা রোগীদের ক্ষেত্রে ডেক্সামেথাসন নামের ওষুধটি ব্যবহার করলে মৃত্যুঝুঁকি এক তৃতীয়াংশ কমে যাবে। এ ছাড়া অক্সিজেন দিয়ে যাদের চিকিৎসা করা হচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করলে মৃত্যুর হার এক পঞ্চমাংশ হ্রাস পেতে পারে।
গবেষকদের দাবি, ব্রিটেনে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার প্রথম দিক থেকেই যদি এই ওষুধ ব্যবহার করা যেত, তাহলে পাঁচ হাজার মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হতো।
গবেষকরা আরো বলেছেন, যেসব দরিদ্র দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি, সেসব দেশে ওষুধটি ব্যবহার করা গেলে তাদের অনেক উপকার হতো। এবং যেসব দেশ রোগীদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে এটা তাদের জন্য বিশাল সুখবর।
অক্সফোর্ড বিশ্বিদ্যালয়ের গবেষক দলটি হাসপাতালে থাকা দুই হাজার রোগীর ওপর ডেক্সামেথাসন ওষুধটির পরীক্ষা করেছে। অন্য চার হাজারেরও বেশি রোগী, যাদের ক্ষেত্রে এই ওষুধটি ব্যবহার করা হয়নি, তাদের সঙ্গে ওষুধটি পাওয়া রোগীদের তুলনা করা হয়।
এতে দেখা গেছে, ভেন্টিলেটরে থাকা রোগীদের ক্ষেত্রে ওষুধটি ব্যবহারের ফলে মৃত্যুর হার ৪০ শতাংশ থেকে ২৮ শতাংশে নেমে গেছে। এ ছাড়া অক্সিজেন নেওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে এ ওষুধ ব্যবহারের ফলে মৃত্যুর হার ২৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নেমে গেছে।
করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত এই ওষুধটিই কেবল মৃত্যুঝুঁকি কমাতে পেরেছে বলে মনে করছে ওই গবেষক দল।