১৩ বছরে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরলেন মির্জা ফখরুল
তেরো বছরে নিত্যপণ্যের দাম কতটা বেড়েছে, তার চিত্র তুলে ধরেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘১৩ বছরে জিনিসপত্রের মূল্য গড় হিসেবে বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। অনেক জিনিসের দাম বেড়ে তিন গুণ হয়েছে। অথচ এসেনশিয়াল কমোডিটিস অ্যাক্ট অনুযায়ী সরকার ১৭টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারে। এই সরকারের প্রতিশ্রুত ১০ টাকার চাল আমজনতা খেয়েছে ৭০ টাকায়।’
এ সময় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘বাজারের প্রতিটি জিনিসের দাম ক্রয়সীমার বাইরে চলে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অগ্নিমূল্য লাগাতারভাবে আমাদের সাধারণের জীবনকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে।
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেন বিএনপির মহাসচিব। এ সময় নিত্যপণ্যের বর্তমান বাজারদরও তুলে ধরেন বিএনপির মহাসচিব। তিনি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে সবাইকে এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের আহ্বান জানান।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বর্তমান সরকার যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ, তা আমাদের প্রিয় নেত্রী দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সময়কালীন সরকারের দ্রব্যমূল্যের সার্বিক চিত্রের সঙ্গে বর্তমান ফ্যাসিবাদ দখলদার সরকারের সময়কালের মূল্যতালিকা তুলে ধরলে সুস্পষ্ট হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে এ পর্যন্ত নিত্যপণ্যের দাম কতটা বেড়েছে, তা তুলে ধরেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩ বছরে জিনিসপত্রের মূল্য গড় হিসেবে বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। অনেক জিনিসের দাম বেড়ে তিন গুণ হয়েছে। ১৩ বছর আগে মোটা চালের দাম ছিল প্রতি কেজি সাড়ে ১৭ টাকা; এখন তা ৩৪ থেকে ৪০ টাকা, আর সরু চাল ছিল সাড়ে ২৪ টাকা, এখন ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা। পেঁয়াজের কেজি ছিল ৮ থেকে ২০ টাকা, এখন তা ২৪০ টাকা। সয়াবিন তেল ছিল লিটারপ্রতি ৫৫ টাকা, এখন তা ৯৫ থেকে ১১০ টাকা। আটা ছিল ১৭ টাকা কেজি আর এখন সেটি বিক্রি হচ্ছে ৩৪ থেকে ৪২ টাকা। চিনি ছিল ৩৭ টাকা, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬০ টাকায়।’
এ সময় মির্জা ফখরুল বলেন, “এসব পণ্যের বাজারমূল্য সম্পর্কে আমরা এখানে উপস্থিত সবাই ওয়াকিবহাল। বাজার থেকে খাবার টেবিল—এ দুই জায়গার বাস্তবচিত্রই ঘুরেফিরে আমাদের সামনে আসে। তবে দ্রব্যমূল্যের ভয়াবহতায় মানুষের জীবন কতটা দুর্বিষহ হতে পারে, তার পুরোটা আমাদের জানা সম্ভবই হয় না। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ কতটা অসহায়, তার একটা উদাহরণই তাদের মানবেতর জীবনযাত্রা সম্পর্কে ধারণা দিতে সক্ষম।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে গ্রাম থেকে আসা এক শিক্ষার্থীর সহজ স্বীকারোক্তি হচ্ছে এ রকম, ‘বাজারে সবজির মূল্যবৃদ্ধির ফলে সবজি খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ, বাজারে এমন কোনো সবজি নেই, যার মূল্য ৮০ থেকে ১০০ টাকার নিচে! এমনকি পেঁয়াজপাতার দামও হচ্ছে কেজিতে ১০০ টাকা।’ প্রশ্ন ছিল, তাহলে তাদের খাদ্য তালিকায় কী থাকে। উত্তর ছিল ডিম এবং যথারীতি এক বাটি পানিসমৃদ্ধ ডাল! তাও একটা ডিম দুজনে ভাগ করে খায়!’
বিএনপির মহাসচিব বলেন, “পেঁয়াজের দুর্মূল্য নিয়ে মাস কয়েক ধরে আমরা কথা বলছি। দেশের সব গণমাধ্যমে এ বিষয়ে প্রতিদিন রিপোর্ট হচ্ছে। সরকারপ্রধান নিজেও ‘পেঁয়াজ বিমানে উঠে গেছে, আর কোনো সমস্যা নাই’ বলেই এয়ার শো দেখতে দুবাই থেকে ইডেনে গার্ডেনস হয়ে এখন আবার মাদ্রিদ শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর এদিকে পেঁয়াজের ঝাঁজ এখন চাল, ডাল, লবণ, তেল, আদা, রসুন থেকে শুরু করে শীতকালীন সব সবজিতে সংক্রমিত হয়েছে। মোটকথা, দৈনন্দিন জীবনে রান্নার জন্য ব্যবহৃত প্রতিটি জিনিসের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমানার বাইরে চলে গেছে। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তা গত কয়েক দিনে প্রকাশিত কিছু সংবাদ শিরোনামই পরিষ্কার করে।”
মির্জা ফখরুল আরো বলেন, ‘বর্তমান অবৈধ সরকার পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে জনগণকে পেঁয়াজ খেতে নিষেধ করছে। তাহলে চালের মূল্য কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা, আটার মূল্য ৫ থেকে ১০ টাকা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে তারা এখন কী বলবেন! ভাত খাওয়া বন্ধ করে দিতে? রুটি খাওয়া বন্ধ করে দিতে? ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে, সুতরাং তেল খাওয়াও কি বন্ধ করে দিতে হবে?’
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘পৃথিবীর সমগ্র দেশেই কখনো কখনো মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য বাড়ে। কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই বা বাড়ার আগেই সরকারের কাজ হচ্ছে বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তবে এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, সরকার, ব্যবসায়ী উৎপাদকের মধ্যে সমন্বয় করা। সেটা তখনই সম্ভব হবে, যখন একটা দক্ষ ও গণবান্ধব সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে।
অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী, পণ্যের সরবরাহ কমলে দাম বাড়ে এবং সরবরাহ বাড়লে দাম কমে। বাজারে যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে, পেঁয়াজ ছাড়া কোনোটির সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। সরকারের একাধিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’র দোহাই দিয়ে বাজার ব্যবস্থাপনাকে সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেওয়ায় এমনটি হয়েছে। জনসংখ্যার হিসাবে দেশে খাদ্যপণ্যের প্রকৃত চাহিদা নিরূপণ করতে পারেনি মন্ত্রণালয়গুলো। ফলে নিত্যপণ্যের বাজারের পুরো ব্যবস্থাপনা বহুমুখী ও ক্রমবর্ধমান সংকটে পড়েছে। নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে বিভিন্ন পণ্যের দাম।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সরকার একদিকে মুক্ত বাজারের দর্শনে বিশ্বাসী, অন্যদিকে নিজস্ব দলীয় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় আগ্রহী। দলীয় ব্যবসায়ীদের দ্বারা তৈরি ব্যবসায়ী জোট ভাঙতে না পারলে, টিসিবিকে শক্তিশালী ও সক্রিয় না করতে পারলে, দলীয় লোকজন দ্বারা পরিবহনের চাঁদাবাজি বন্ধ না করতে পারলে এবং মধ্যস্বত্বভোগের ব্যবস্থা বন্ধ না করতে পারলে দ্রব্যমূল্য হ্রাস করা সম্ভব হবে না।’