হাঁস পালনে অন্যরকম সফলতার গল্প
হাঁস পালন ভাগ্য পাল্টে দিচ্ছে কিশোরগঞ্জের ভৈরবের গ্রামাঞ্চলের অনেক বেকার ছেলেমেয়ের। আর একজনের সাফল্যে অন্যরাও উৎসাহিত হয়ে গড়ে তুলছে খামার। এতে বৃদ্ধি পাচ্ছে খামার ও খামারির সংখ্যা।
স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে মাংস ও ডিম বিক্রি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। অপরদিকে প্রাণিজ পুষ্টির ঘাটতি পূরণসহ জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই হাঁসের খামারগুলো।
এখানকার সফল খামারিদের একজন হলেন মো. হিমেল মিয়া। ভৈরব উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের মানিকদী বড়কান্দা গ্রামের বাসিন্দা। পড়তেন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। চতুর্থ সেমিস্টারের পর পরিবারের আর্থিক অনটনের কারণে বন্ধ হয়ে যায় তাঁর পড়াশোনা।
ঋণ নিয়ে ২০১৪ সালে হিমেল পাড়ি জমান মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে। সেখানে ভালো চাকরিও জুটে যায়। দুই বছর তাঁর বেশ ভালোই কাটে। কিন্তু ২০১৭ সালে সৌদি আরবসহ বেশ কিছু দেশের অবরোধের কারণে কাতারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় অনেক কল-কারখানা। চাকরি হারান হিমেল মিয়া। ২০১৮ সালে তাঁকে ফিরে আসতে হয় দেশে। তবে তিনি কাতারে থেকেই চিন্তা করতেন দেশে ফিরে কী করতে পারেন। অনেক ভেবেচিন্তে হাঁস পালনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন।। এর প্রধান কারণ হলো তাঁর বাড়ির আশপাশের পরিবেশ। গ্রামের পাশে নদী। নদীতে শামুক, পোকা-মাকড়, তারপর ধান চাষ। সব কিছু মিলিয়ে হাঁস পালনের জন্য একটা চমৎকার পরিবেশ থাকায় তিনি অন্যকিছু করার চিন্তা বাদ দিয়ে হাঁস পালনকেই তিনি বেছে নেন তাঁর নতুন কর্ম হিসেবে।
হিমেল কাতারে থেকেই কুরিয়ারের মাধ্যমে ঢাকা থেকে একটা ইনকিউবেটর সার্কিটের অর্ডার করেন। দেশে ফিরে সেটা স্থাপন করেন তাঁর বাড়িতে। প্রথমে পরীক্ষামূলক ১০০ ডিম দিয়ে তিনি শুরু করেন। ১০০ ডিম থেকে ২৮ দিন পর ৬০টা বাচ্চা হয়। পরে সেগুলো লালন পালন করে ভালো ফিডব্যাক পান। দেখেন ৮০ ভাগ প্রাকৃতিক খাবারেই তাঁর হাঁসগুলো বেড়ে উঠছে।
ভালো ফলাফল দেখে হিমেল পরবর্তী সময়ে এলাকার হ্যাচারি থেকে একদিন বয়সী ৬০০ বাচ্চা নেন। এইগুলা লালন পালন করতে থাকেন। দুই মাস ১৮ দিন লালন পালন করে হাঁসগুলো বিক্রি করে দেন। এই দুই মাসে তাঁর প্রায় ৪৫ হাজার টাকা খরচ হয়। আর হাঁস বিক্রি করেন এক লাখ ১৫ হাজার টাকা। তাতে তাঁর প্রায় ৭০ হাজার টাকা লাভ হয়। এতে তিনি উৎসাহিত হয়ে ওই সিজনে আরো দুই কিস্তি হাঁস পালন করে বেশ লাভবান হন।
চলতি বছর হিমেল পাঁচ হাজার হাঁস উঠান। এই পাঁচ হাজারের মধ্যে চার হাজার হাঁসই আড়াই মাস বয়সে বিক্রি করে দেন। এতে তাঁর মুনাফা হয় প্রায় তিন লাখ টাকা। বাকি এক হাজার হাঁস রেখে দিয়েছেন ডিম দেওয়ার জন্য। ডিমপাড়া হাঁস লালন করলে ডাবল লাভ হয় বলে তিনি জানান। প্রথমত ডিমের লাভ দ্বিতীয়ত ডিম পাড়া শেষ করলে মাংসের জন্য বিক্রি করা হয় হাঁসগুলো।
হাঁস পালন করে লাভের গল্প শুনালেন একই এলাকার মুজাহিদ মিয়াও। তিনি জানান, তাঁর খামারে তিনি ৫০০ হাঁসের বাচ্চা উঠিয়েছিলেন। যাদের বর্তমান বয়স দুই মাস ১০ দিন। তিন মাস পূর্ণ হলে তিনি বিক্রি করে দেবেন। এতে তাঁর খরচ হবে ৭০ হাজার টাকার মতো। বিক্রি করে মুনাফা হবে এক লাখ টাকারও বেশি। তিনি হিমেল মিয়ার সফলতা দেখে হাঁসের খামার গড়েছেন বলেও জানালেন।
আর এক সফল হাঁসের খামারি মানিকদী পূর্বকান্দা গ্রামের সানাউল্লাহ মিয়া। তিনি চার বছর ধরে হাঁসের খামারের সঙ্গে জড়িত। তিনি বছরের দুই সিজনে দেড় হাজার করে মোট তিন হাজার হাঁস পালন করেন। প্রতি সিজনে তাঁর খরচ হয় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। বিপরীতে মুনাফা হয় আট থেকে ১০ লাখ টাকা। অর্থাৎ হাঁস পালন করে তিনি বছরে মোট মুনাফা করেন ১৬ থেকে ২০ লাখ টাকা।
ছোটবেলা থেকেই হাঁস পালনের সঙ্গে জড়িত ভৈরব পৌর এলাকার ব্রহ্মপুত্র নদঘেঁষা গ্রাম লক্ষ্মীপুরের মেয়ে কল্পনা বেগম। তিনি জানান, হাঁস পালন বেশ লাভজনক। এই হাঁস পালন করেই তিনি উন্নতি করেছেন। অল্প আয়ের স্বামীর সংসারে স্বচ্ছলতা এনেছেন।
কল্পনা জানান, হাঁস পালনে অল্প খরচে অনেক লাভ। পুঁজি বেশি খাটালে, লাভের পরিমাণও বেশি হয়। তিনি আক্ষেপ করে জানান, তাঁর পুঁজি কম থাকায় তিনি বড় করে খামার করতে পারছেন না।
ভৈরবে হাঁস পালন করে খামারিরা বেশ লাভবান হচ্ছে জানিয়ে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘হাঁসের খামারিদের আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছি। ফলে এখানে হাঁস পালন ও খামারিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
হাঁসের ডিম মুরগির ডিমের চেয়ে বেশি পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ জানিয়ে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আরো জানান, এসব খামারি পুষ্টির চাহিদা পূরণ করা ছাড়াও জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছেন। নিম্নাঞ্চল ও চর অঞ্চলের মানুষ যদি বেশি করে হাঁস পালনের দিকে ঝোঁকে, তবে তারা অনেক লাভবান হবে। তাদের বেকারত্ব দূরসহ প্রাণিজ পুষ্টি উৎপাদনে ভূমিকা রাখতে পারবে।