শিশুর ‘স্বীকারোক্তি’ নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা অপরাধ করেছেন : হাইকোর্ট
বগুড়ায় ছোট ভাইকে হত্যা মামলায় ১২ বছর বয়সী বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ‘স্বীকারোক্তি’ নিয়ে সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা অবেহলা নয়, অপরাধ করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।
১২ বছর বয়সী শিশুটির কাছ থেকে ‘জোর করে’ স্বীকারোক্তি নেওয়ার অভিযোগ বিষয়ে সাবেক তদন্ত কর্মকর্তার লিখিত ব্যাখ্যা দাখিলের পর আজ রোববার বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. আতোয়ার রহমানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।
এর আগে গত ১১ আগস্ট হাইকোর্ট ১২ বছর বয়সী শিশুটির কাছ থেকে ‘জোর করে’ স্বীকারোক্তি নেওয়ার বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা জানাতে সারিয়াকান্দি থানার সাবেক উপপরিদর্শক (এসআই) নয়ন কুমারকে (বর্তমানে পরিদর্শক, সিআইডি, নাটোর) ২২ আগস্ট আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে মামলার কেস ডকেটসহ মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা মো. মনসুর আলীকে (উপপরিদর্শক, পিবিআই বগুড়া) আদালতে হাজির হতে বলা হয়। আজ সকালে সাবেক ও বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে হাজির হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বলেন, সাবেক ও বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা হাজির হয়েছেন। সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা নয়ন কুমার লিখিত জবাব দিয়েছেন।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে আদালত বলেন, উনি (নয়ন কুমার) জবাবে সরাসরি বিচারপতিদের অ্যাড্রেস করেছেন। উনি কী এটি পারেন, জিজ্ঞাসা করেন। উনি কীভাবে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি নিয়েছেন জিজ্ঞাসা করেন। উনি ১২ বছর বয়সী শিশুর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি কীভাবে নিয়েছেন, বলতে বলেন।
মামলার বৃত্তান্ত তুলে ধরে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নারী ও শিশু আদালত পিবিআইকে মামলাটি অধিকতর তদন্ত করতে নির্দেশ দেন। পিবিআই তদন্তকালে দুজনকে গ্রেপ্তার করে, তারা নিজেদের জড়িয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। আদালত বলেন, তারা ১২ বছর বয়সী শিশুটির নাম বলেনি।
এ সময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আদালত ওনাকে (নয়ন কুমার) আসতে বলেছেন, উনি এসেছেন। উনি নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে আবেদন দিয়েছেন। পিবিআইয়ের যিনি এখন তদন্ত করছেন, তিনি মামলার চতুর্থ তদন্ত কর্মকর্তা। অধিকতর তদন্তের জন্য রাষ্ট্রপক্ষ বিচারিক আদালতে আবেদন করেছিল। উনি ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন, আদালত সন্তুষ্ট হলে ক্ষমা করে দিতে পারেন। কেননা, উনি (নয়ন কুমার) প্রসিকিউসনের অংশ।
আদালত বলেন, ‘উনি (নয়ন কুমার) ভুল করলে আমরা কি ছেড়ে দেব?’
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপনারা বিবেচনা করবেন। উনি (নয়ন কুমার) প্রসিকিউসনের অংশ। উনি ভুল করে ফেলেছেন, সে জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চাচ্ছেন।’
আদালত বলেন, তার (নয়ন) দ্বারা গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ক্রাইম বলবেন, নাকি অবহেলা?
আদালত বলেন, না। উদ্দেশ্যমূলকভাবে উনি এটি করেছেন। ভুক্তভোগীর ১২ বছর বয়সী ভাইয়ের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নিয়ে ভাইকে মেরে ফেলেছে বলা হয়েছে। এটি কি সম্ভব ৮ বছর বয়সী ছেলেকে ১২ বছর বয়সী ছেলে মেরে ফেলবে?
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন বলেন, এটি হৃদয়বিদারক ও স্বাভাবিক না।
আদালত বলেন, ‘তাহলে আপনি কীভাবে ১৬৪ আবেদন দিলেন ও নিলেন? রাষ্ট্রপক্ষ ইতিমধ্যে অধিকতর তদন্ত চেয়েছে, পিবিআই তদন্ত করছে। এতে দুজন স্বীকার করেছে, তারা আট বছর বয়সী শিশুটিকে মেরেছে। তাহলে ১২ বছর বয়সীর শিশুটির জবানবন্দি কীভাবে নিলেন এই তদন্ত কর্মকর্তা (নয়ন)। এটি তো মারাত্মক ধরনের অভিযোগ। অবহেলা কখন হয়, মনের অজান্তে হয়। এটি অবহেলা নয়।’
তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ওই কর্মকর্তার (নয়ন) বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা সম্পর্কিত কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
এরপর আদালতের জিজ্ঞাসার জবাব দেন সাবেক ও বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা। আদালত নয়ন কুমারের লিখিত ব্যাখ্যায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। ৬ সেপ্টেম্বর পরবর্তী শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন। সেদিন নয়ন কুমারকে আদালতে উপস্থিত হতে বলা হয়েছে। ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে আপাতত অব্যাহতি দিয়ে বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা মো. মনসুর আলীকে ধার্য তারিখে ভার্চ্যুয়ালি আদালতে যুক্ত থাকতে বলা হয়েছে।
জোর করে ১২ বছর বয়সী শিশুর স্বীকারোক্তি নেওয়ার বিষয়ে গত ১১ জুন ‘বিয়ারিং দ্য আনবিয়ারেবল’ শিরোনামে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। এটি যুক্ত করে বগুড়ার আদালতে থাকা ওই হত্যা মামলার যথার্থতা ও আইনি দিক পর্যালোচনায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ আইনজীবী ২০ জুন হাইকোর্টে ওই আবেদন করেন, যার ওপর ২৯ জুন শুনানি হয়।
শুনানি নিয়ে আদালত প্রথম তদন্ত কর্মকর্তার কাছে লিখিত ব্যাখ্যা চেয়ে দুই তদন্ত কর্মকর্তাকে ৩ আগস্ট হাজির হতে নির্দেশ দিয়ে আদেশ দেন। এর ধারাবাহিকতায় ১১ আগস্ট বিষয়টি ওঠে। সেদিন আদালত ২২ আগস্ট তাঁদের হাজির হতে নির্দেশ দেন।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালের ২৫ আগস্ট ৮ বছরের শিশুর মরদেহ উদ্ধারের এক দিন পর সারিয়াকান্দি থানায় মামলা করেন তার বাবা মহিদুল। একই বছরের ২৯ নভেম্বর স্থানীয় থানা-পুলিশ তাঁর বাড়িতে যায়। জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে ১২ বছর বয়সী বড় ছেলেকে নিয়ে যায় তারা। পরদিন ৩০ নভেম্বর ১২ বছর বয়সী শিশুটিকে বগুড়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়।