মিথ্যা তথ্য দিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছি : নবাবের ‘নাতি’
দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গত ১৮ মার্চ। সেদিন ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়। সেই ব্যক্তির জানাজা পড়ানো নিয়ে মিথ্যা তথ্য প্রচার করেন ঢাকার নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহর ‘নাতি’ পরিচয় দেওয়া নবাব খাজা আলী হাসান আসকারী।
দাফনের পরদিন ১৯ মার্চ আলী হাসান আসকারী তার ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফনে তার স্বজনদের কেউ উপস্থিত ছিলেন না। জানাজা আমি একা পড়িয়েছি।’
প্রায় সোয়া তিন কোটি টাকা প্রতারণা করার অভিযোগে সেই আলী হাসান আসকারী এখন কারাগারে। কারাগারে পাঠানোর আগে আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডের ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কার্যালয়ে আলী হাসান আসকারীর সঙ্গে কথা হয় এনটিভি অনলাইনের।
সে সময় আসকারীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, ‘দেশে করোনায় মারা যাওয়া প্রথম ব্যক্তির জানাজা কী আপনি পড়িয়েছিলেন?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি পড়াইনি। তবে দাফনে সহযোগিতা করেছিলাম।’
তাহলে আপনি (আসকারী) কেন আপনার ফেসবুকে ভুয়া তথ্য প্রচার করেছিলেন? এই প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নে আসকারী বলেন, ‘ভুল করেছি। মিথ্যা তথ্য দিয়েই আজ গ্রেপ্তার হয়েছি।’
আলী হাসান আসকারী নানাভাবে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। মিষ্টভাষী এই ব্যক্তির কথা বলার ধরন বা কার্যকলাপে বোঝা মুশকিল, তিনি এমন বড় মাপের প্রতারক। প্রতারণার কৌশলে তিনি করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতির ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ করিমকেও হার মানিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন মামলার তদন্তকারী সূত্র এবং ভুক্তভোগীরা।
আজ দুপুরে ডিএমপির কাউন্টার টেরোররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সদস্যরা আসকারীকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়িতে তোলেন। সে সময় আসকারীর কাছে সাড়ে ছয় লাখ টাকা দিয়ে প্রতারিত হওয়া মিজানুর রহমান প্রামাণিক তাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আসকারী ভাই, আমার টাকার কী হবে?’
মিজানুরকে চিনতে পেরে আসকারী বলে ওঠেন, ‘কেমন আছেন? গাইবান্ধা থেকে এসেছেন? চিন্তা করবেন না। আমি হাসপাতাল থেকে এসে দেখা করব।’ পুলিশ আসকারীকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিল তা তখনো জানতেন না মিজানুর।
পরে মিজানুর রহমান প্রামাণিক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আসকারী আমার বাড়িতে গিয়েছিলেন। ২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর আমি একটি মাহফিলের আয়োজন করি। সেই মাহফিলে তিনি যান। গিয়ে ভরা মজলিসে ঘোষণা দেন এখানে তিনি নবাব বংশের হয়ে কিছু করতে চান। গাইবান্ধার পাঁচগাছি হাফিজিয়া মাদ্রাসাটি তিনি বড় করতে চান। ১০০ বিঘা জমি কিনে দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেন। এই মাদ্রাসা তৈরি করার জন্য কিছু অনুমোদন দরকার, সেজন্য তিনি আমার কাছ থেকে দফায় দফায় সাড়ে ছয় লাখ টাকা নেন। পরে আমি তার কাছে কাজের অগ্রগতি জানতে চাইলে তিনি আমাকে ফেসবুকে ব্লক করে দেন।’
আজ সকাল সাড়ে ১০টা থেকে মিন্টো রোডে থেকে আলী হাসান আসকারীর কাছে প্রতারিত হওয়া এমন ছয়জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয় এনটিভি অনলাইনের। তাদের ভেতর একজন ফেনীর স্কুলশিক্ষক আবদুল আহাদ সালমান। তিনি চলতি বছরের জুন-জুলাইয়ে আসকারীর কাছে চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা মোট তিন কোটি ৩৪ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। যার পুরো টাকাই হাতিয়ে নিয়েছেন আসকারী ও তার সহযোগীরা। ওই অভিযোগে সালমান রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় প্রতারণার মামলা করেন। ওই মামলায় গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টার পরে আসকারীসহ মোট ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
আবদুল আহাদ সালমান কীভাবে প্রতারণার শিকার হলেন তা বলতে গিয়ে আজ শনিবার বিকেলে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘হঠাৎ একদিন আসকারী আমাকে ফেসবুকে রিকুয়েস্ট পাঠান। আমি গ্রহণ করার পর তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। একদিন আমাদের ফেনীর ধুমসাদ্দা মাদ্রাসা নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। সে সময় তিনি আমাদের মাদ্রাসাকে বড় করার সহযোগিতার কথা বলেন। তারপর থেকে তার সঙ্গে আমার মাঝেমধ্যে কথা হতো। তিনি মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন, সেটা বলেন। নেদারল্যান্ডে বসবাস করেন এবং আমেরিকায় বড় হয়েছেন বলে আমাকে জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া তার বাবা সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের পরিচালক, দুবাইয়ে আছে তার সোনার কারখানা এবং তার বাবা ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বলেও আমাকে জানিয়েছিলেন।’
আবদুল আহাদ সালমান বলেন, ‘এভাবে একদিন তিনি (আসকারী) আমাকে বলেন, মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ৭০০ লোক দরকার। সেখান থেকে আমাকে চারশ লোক দিতে বলেন। এবং জানান তাদের কোনো টাকা দিতে হবে না। এই ঘটনা আমি আমার পরিচিতজনদের জানাই। আমার বাবা-দাদাদের এলাকার মানুষজন সম্মান করেন। সেজন্য এই তথ্যটি দ্রুতই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে আমি আসকারীকে বিষয়টি জানাই। সে সময় তিনি আমাকে সবার তালিকা দিতে বলেন। তালিকা দেওয়ার পর বললেন, সবাইকে মেডিকেল করতে হবে। মেডিকেল করার জন্য সাড়ে আট হাজার টাকা করে দরকার। একদিন তিনি আমাকে বলেছিলেন, এই সাড়ে আট হাজার করে ওঠানো টাকা তিনি আমার মাদ্রাসায় স্থায়ীভাবে দিবেন। যাতে আমার মাদ্রাসাটা বড় হয়। এভাবে একদিন মোট ৪০০ জনকে নিয়ে আমি ঢাকায় গেলাম। এরপর তিনি আমাদের ঢাকা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যান। নমুনা হিসেবে ভুক্তভোগীদের রক্ত ও প্রস্রাবের নমুনা নেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের কোনো সনদ দেননি তিনি।’
‘মেডিকেল করার পরে জানালেন, চাকরিপ্রার্থীরা ওয়ার্ড বয় হিসেবে কর্মরত ছিলেন এমন একটি সনদ দরকার সরকারি হাসপাতাল থেকে। সেজন্য ৭৫ হাজার টাকা করে চান তিনি। পরে ছয় দফায় তাকে আমি মোট তিন কোটি ৩৪ লাখ টাকা দেই। এই টাকা বিকাশে এবং সরাসরি দিতে হয় তাকে। কারণ তিনি ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা নিতে চাননি। টাকা পাওয়া শেষ হয়ে গেলে তিনি আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, তার এত মিষ্টি মিষ্টি কথা, যে বোঝার উপায়ই নেই তিনি এমন। চূড়ান্তভাবে প্রতারিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি তার আশেকই ছিলাম। মুগ্ধ ছিলাম তার আচার-ব্যবহারে। এত সূক্ষ্মভাবে প্রতারণা করা যায়, তাকে না দেখলে ভাবা যায় না। আমার মনে হয়, করোনার রিপোর্ট নিয়ে প্রতারণা করা রিজেন্ট হাসপাতালের মো. সাহেদ আসকারীর কাছে ছোট বাচ্চা নয়, খুবই ক্ষুদ্র।’ যোগ করেন আবদুল আহাদ সালমান।
শনিবার বিকেলে রাজধানীর হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে বসেছিলেন আসকারীর প্রতারণার শিকার হওয়া আবদুল আহাদ সালমান, হাফিজুর রহমান বাবু, সেলিম রেজা ও মাহমুদ আলী। তাঁরা সবাই উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার পরও আসকারীর প্রতারণার জালে ধরা দিয়েছেন। কে কোন প্রক্রিয়ায় ধরা খেয়েছেন তা নিয়ে তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে মাঝেমধ্যে সবাই হেসে ওঠেন। একটু পরেই আবার মুখ গোমড়া করে ফেলেন। এমন সময় হঠাৎ সেলিম রেজা নামের একজন বলে ওঠেন, ‘এত ভদ্র-নম্র আর সাবলীল ভাষায় মানুষের বুকে ঢুকে ছুরি মারা যায়, তা আমি আসকারী সাহেবকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। তাঁর কথা শুনলে মনে হয় পৃথিবীতে তাঁর মতো ভালো মানুষ আর একজনও নেই। অথচ, তার মতো প্রতারক বাংলাদেশে একজনও আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রাখা যায়।’ এই কথা বলে পুনরায় সবাই হাসতে থাকেন।
প্রতারণার শিকার হাফিজুর রহমান বাবু বলেন, ‘আসকারীর সঙ্গে পরিচয়ের পর তিনি একদিন আমাকে ফোন করে বলেন, পুলিশের এসআই নিয়োগ দেবে। আমার পরিচিত লোক থাকলে যেন জানাই। পুলিশ প্রধান তাঁর মামু বলে পরিচয় দেন তিনি। আমি দুজনের কথা আসকারীকে জানাই। পরে তিনি আমাকে ২০ ভরি ওজনের স্বর্ণের গহনা দিতে বলেন পুলিশ প্রধানের বউকে দেওয়ার জন্য। কারণ, তিনি টাকা দিবেন না, দিবেন উপহার। এভাবে আমি আমার জমানো টাকাসহ হাওলাদ করে মোট ছয় লাখ টাকা ঢাকায় এসে দেই তার (আসকারী) কাছে। তারপর থেকে আর যোগাযোগ করেন না তিনি (আসকারী)। কী সুন্দর করে কথা বলেন তিনি। বোঝাই যায় না, তিনি এত খারাপ লোক।’
আলী হাসান আসকারীকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছিল কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। রিমান্ডে আসকারী কী তথ্য দিলেন জানতে চাইলে সিটিটিসির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এখনো পর্যন্ত যা তার (আসকারী) কাছ থেকে শুনেছি তা হলো, তিনি ২০১৪ সাল থেকে নবাব পরিবারের পরিচয় দেন প্রতারণা করার জন্য। এই পরিচয়ে তিনি বহু মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তার বিরুদ্ধে আরো মামলা হচ্ছে এবং হবে। আমাদের কাছে ভুক্তভোগীরা আসছেন। তার মতো প্রতারক আমি কখনোই দেখিনি। রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম তো তাঁর কাছে বাচ্চা শিশুর চেয়েও ছোট। সুন্দর করে কথা বলে প্রতারণা করাই তার প্রধান হাতিয়ার।’