‘পঙ্গুত্বের পথে খালেদা জিয়া, মানবিক কারণে জামিন চাই’
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য রিপোর্ট আদালতে পেশ করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু এই চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার অনুমতি দরকার। তিনি হাত ও পা নড়াচড়া করতে পারেন না। ক্রমান্বয়ে পঙ্গুত্বের দিকে যাচ্ছেন। এ জন্য উনার শরীরে কোনো মেডিসিন পুশ করা যাচ্ছে না।
আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ১০ মিনিটে শুরু হওয়া জামিনের আপিল শুনানিকালে খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘খালেদা জিয়া সুস্থ অবস্থায় হেঁটে হেঁটে কারাগারে প্রবেশ করেছিলেন। তিনি এখন এতই অসুস্থ যে পুরোপুরি পঙ্গু অবস্থায় চলে গেছেন, ছয় মাস পর তো তাঁর লাশ বের হবে। ওপরে আল্লাহ আছেন আর আপনারা এখানে আছেন, আর কাউকে বলার জায়গা নেই। আমরা বারবার জামিনের জন্য আসছি এ কারণেই যে তিনি ৭৫ বছরের একজন নারী, ২২ মাস যাবৎ জেলে আছেন। মানবিক কারণে তাঁর জামিন চাই।’
এরপর আদালত শুনানির বিরতি দিয়ে এজলাস দিয়ে নেমে যান।
খালেদা জিয়ার পক্ষে অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, খন্দকার মাহবুব হোসেন, এ জে মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, নিতাই রায় চৌধুরী, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, সগীর হোসেন লিয়ন ও ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, রাশেদা আলীম ঐশীসহ অর্ধশত আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলমসহ অর্ধশত আইনজীবী রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে আজ সকাল ১০টা ১০ মিনিটে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিনের আপিল শুনানি শুরু হয়। শুরুতে বিএসএমএমইউর মেডিকেল বোর্ডের দেওয়া খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট আপিল বিভাগে উপস্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল। এরপর রিপোর্ট পড়ে দেখেন প্রধান বিচারপতি।
এদিকে খালেদা জিয়ার জামিনের আপিল শুনানিকে কেন্দ্র করে আজ সকাল থেকে হাইকোর্ট এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আদালতের স্টাফ ও আইনজীবীদের পরিচয়পত্র দেখে তল্লাশি করে ভেতরে ঢুকতে দেয় পুলিশ। হাইকোর্টের তিনটি ফটকে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আদালতের ভেতরে আপিল বিভাগে প্রবেশের আগে দুটি গেটে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কঠোর অবস্থানে আছেন।
খালেদা জিয়ার জামিন শুনানিতে আপিল বিভাগের তালিকাভুক্ত আইনজীবী ছাড়া হাইকোর্টের কোনো আইনজীবীকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এতে বিএনপির জ্যেষ্ঠ কয়েকজন আইনজীবী ছাড়া জুনিয়র বা হাইকোর্টের আইনজীবীদের প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। তবে আপিল বিভাগের তালিকাভুক্তকরণ না থাকলেও রাষ্ট্রপক্ষে সহকারী অ্যাটর্নি ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলরা প্রবেশ করেছেন। এ নিয়ে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের সঙ্গে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বাকবিতণ্ডা হয়।
আদালতে খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রধান বিচারপতিকে বিষয়টি উপস্থাপন করে বলেন, ‘আমাদের আইনজীবীদের প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ সরকারি সব আইনজীবী প্রবেশ করেছেন।’
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আজকে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেসব আইনজীবীর আপিল বিভাগে তালিকাভুক্ত নেই, তাঁদের প্রবেশ করতে অনুমতি দেব না।’
এরপর খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘আমি বৃদ্ধ বয়সে কি মামলার নথি কাঁধে করে হাঁটব? আমার জুনিয়র না এলে আমি শুনানি কীভাবে করব? এই যদি হয়, তাহলে আমরা মামলার শুনানি করব না।’
এ সময় খন্দকার মাহবুব হোসেন আপিল বিভাগে প্রবেশের বিষয়ে একটি রায় উপস্থাপন করেন।
এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতকে বলেন, তাহলে দুপক্ষের সমান সংখ্যক আইনজীবীকে প্রবেশ করতে দেওয়া হোক।
তখন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষে ও খালেদা জিয়ার পক্ষে মোট ৩০ জন করে ৬০ জনকে আপিল বিভাগে প্রবেশের অনুমতি দেন। এ ছাড়া বাকি সবাইকে আদালত কক্ষ থেকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। এ জন্য পাঁচ মিনিট সময় দেন প্রধান বিচারপতি। এরপর এজলাস থেকে নেমে যান পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। দুপক্ষের ৩০ জন করে ৬০ জন আইনজীবী থাকার পর এজলাসে প্রবেশ করেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। এরপরও দুপক্ষের অনেক আইনজীবী এজলাসে ঢুকে পড়েন।
গত বছরের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে সাত বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি ১০ লাখ টাকা টাকা জরিমানা করা হয়। এ মামলায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে আরো তিন আসামিকে সাত বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।
রায়ের পর ২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে খালাস চেয়ে আপিল করেন খালেদা জিয়া।
ওই মামলায় গত ৩১ জুলাই হাইকোর্টের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ করে আদেশ দেন। এরপর গত ১৪ নভেম্বর সাতটি গ্রাউন্ডে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় খালেদা জিয়ার জামিন চেয়ে আপিল আবেদন করা হয়। ১৭ নভেম্বর আবেদনটি আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি মো. নূরুজ্জামানের আদালতে উপস্থাপন করা হয়। ২৫ নভেম্বর শুনানির পর বিচারক সেটি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠানোর আদেশ দেন।
গত ২৮ নভেম্বর খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থা জানতে তাঁর বিষয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদন ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে দাখিলের নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ। কিন্তু সেদিন প্রতিবেদন দাখিল করতে না পারায় আদালত ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করে শুনানির জন্য আজকের দিন নির্ধারণ করেন।